তাজুল ইসলাম নয়ন॥ একবিংশ শতাব্দিতে প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক অচেনাকে চিনতে ও জানতে পেরেছি আমরা। তারপরেও রহস্যঘেরা এই পৃথিবীতে এখনো অনেক রহস্য অজানাই রয়ে গেছে। যেগুলো উন্মোচন করতে গিয়ে প্রযুক্তিও ব্যর্থ হচ্ছে। এমনই একটি রহস্য হলো আটলান্টিক মহাসগরের একটি বিশেষ অঞ্চল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। একে পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান বলে মানা হয়। কারণ এ পর্যন্ত এখানে যত রহস্যময় দূর্ঘটনা ঘটেছে অন্য কোথাও এ রকম ঘটেনি। আর এই ঘটনাগুলোর রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। এ জন্যই স্থানীয় অধিবাসীরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করেছে শয়তান বা পাপাত্মাদের ত্রিভুজ। যারা এই বারমুড়া ট্রায়াঙ্গল সম্পর্কে জানেন না তাদের জন্য আজ দেয়া হলো অজানা কিছু তথ্যা।
ক্যারিবীয় সাগরের এক ত্রিভুজ এলাকা হলো বারমুড়া ট্রায়াঙ্গল। এই এলাকাটি আটলান্টিক মহাসাগরের তিন প্রান্ত দিয়ে সীমাবদ্ধ। বারমুড়া ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ তার এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা আরেক প্রান্তে পুয়ের্তেঅ রিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বারমুড়া দ্বীপ অবস্থীত। এ অঞ্চলটির মোট আয়তন ১১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৪ লাখ বর্গ মাইল।
ট্রায়াঙ্গল নিয়ে যত রহস্য: বারমুড়া ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময়তার অন্যতম একটি দিক হলো, জাহাজ নিঁখোজ হয়ে যাওয়া। কলম্বাসের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একই ব্যাপার ঘটে চলেছে। কোনো জাহাজ এই ট্রায়াঙ্গলে প্রবেশ করলেই বেতার তরঙ্গ প্রেরণে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং এর ফলে জাহাজটি উপকুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়। এক সময় তা দিক নির্ণয় করতে না পেরে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার এক মাস আগে নিখোজ হয়ে যাওয়া জাহাজও ভ’তুড়েভাবে ভাসতে দেখা যায় এই স্থানে। ক্রিষ্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম ১৪৯২ সালের ১১ অক্টোবর তার লগবুকে এই বারমুড়া ট্রায়াঙ্গল নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা লিখেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তার জাহাজের নাবিকরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি আর আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক-নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন। ১৯৮১ সালে সেখোনে ইউএস নেভির কয়েকটি জাহাজ নির্খোজ হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে সাইক্লোপক জাহাজের অদৃশ্য হওয়া। তাতে ছিল ৩০৯ জন যাত্রী। ১৯ হাজার টন ভারী জাহাজটি বারবাডোস থেকে বাল্টিমোরের দিকে যাত্রা করেছিল। এ জাহাজটি সেখানে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের একটি রহস্যময় অঞ্চল হলো জলীয় কেন্দ্রের একটি বিন্দু। ফ্লোরিডা থেকে বাহামার মধ্যে এর অবস্থান। এই অঞ্চলকে বলা হয় রেডিও ডেড ষ্পট। এখানে কোনো বেতারতরঙ্গ প্রবেশ করতে পারে না এবং বের হতেও পারে না। অনেকে এখানে ফ্লাইং সসার্স দেখার কথা স্বীকার করেন। তাদের মতে, ভিন গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে আসার জন্য এই অঞ্চলটি বেছে নিয়েছে। এটিও এই ট্রায়াঙ্গলের একটি বড় রহস্য।
বারমুড়া ট্রায়াঙ্গলের আরো একটি রহস্য হচ্ছে, একটি অদ্ভুত জৈবের উপস্থিতি। টেডি টাকার নামের এক ডুবুরি বারমুড়ার বেলাভ’মিতে ১৫০০ থেকে ২০০০ পাউন্ড ওজনের উজ্জ্বল সাদা একটি পিন্ড আবিস্কার করেছিলেন। স্থানীয় লোকেরা ওই রহস্যময় বস্তুটির নাম দিয়েছিল বারমুডা ব্লপ্ন। এই পিন্ড থেকে একটি টুকরা কেটে নিয়ে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ গবেষণা করে। গবেষণায় পাওয়া যায় ওই পিন্ডটি কোনো প্রাণীদেহের অংশ। রহস্যময় ব্যাপার হলো প্রাণীদেহের অংশ হওয়া সত্ত্বেও পিন্ডটির কোনো ধরণের পচন লাগেনি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় ঘটনাঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যভেদ করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে গবেষকরা। অনেকের মতে, এখানো চুম্বকীয় তত্ত্ব কাজ করছে। এই অঞ্চলে আকাশ ও সমুদ্রের মধ্যে এক তড়িতাহত ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে। আবার কারো মতে ওই রহস্যময় জায়গায় পর্যায়ক্রমে অজানা এক রাসায়নিক যৌগের সৃষ্টি হয়। সেই যৌগ যাবতীয় ইচ্ছাশক্তি ও ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি অবশ করে দেয়। সমুদ্রের মধ্যে বিভিন্ন বিপাক ক্রিয়ার ফলে এক অজানা জৈবের রাসায়নিক বিক্রিয়া চলে। এর ফলেই ঘটে যায় রহস্যময় ঘটনা। কেউ বলেন, এই ট্রায়াঙ্গলে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভ’মিকম্পের জন্য পাহাড়সম বিশাল ঢেউ তৈরী হয়। যে কারণে জাহাজ-উড়োজাহাজ সব কিছুকে নিজের গহবরে টেনে নেয়। আবার অনেকেই বলেন ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ মাত্রার কথা। তাদের মতে সময়ের একটা অনন্ত ফাটল এই ট্রায়াঙ্গলে সক্রিয় থাকে। ওইসব জাহাজ ও বিমান সময়ের সেই রহস্যময় ফাটলে পড়ে হারিয়ে যায়। তবে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও লেখক একে অতিরঞ্জিত গল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলটি হলো প্রমোদতরীর বিচরণক্ষেত্র। এই ট্রায়াঙ্গলের আকাশপথও একটি ব্যস্ত রুট। এর মধ্যদিয়ে বিভিন্ন রুটের বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত বিমান চলাচল করে। তাই একে ঘিরে থাকা রহস্যকে অনেকেই আবার বাণিজ্যিক রহস্য বলেছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যেল সত্যতা থাকুক আর নাই থাকুক, এটি সব সময়ই মানুষের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।