টিআইএন॥ ১৯৭৫ সালে বিদেশে না যেতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আবদার ধরেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মা তুই যা। জামাইয়ের (প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া) অসুবিধা হচ্ছে। সঙ্গে রেহানাও যাবে। পিতার কথার অবাধ্য হননি শেখ হাসিনা। এ কারণেই ১৫ আগষ্ট বেঁচে যান তারা দুই বোন। সেই সর্বনাশা রাথে হারান বাবা, মা, ভাই ও নিকটাত্মীয়দের। এই অশেষ শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে পিতার অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের নিরন্তর কাজ করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল খুনি চক্র। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করাও ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তারা কল্পনাও করতে পারেনি একদিন আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে আসার পর জনগণের রায়ে ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। যুদ্ধপারাধীদের বিচারের পর ফাঁসির দন্ডও কার্যকর করেছেন। এ কারণেই সাম্প্রদায়িক খুনি চক্র শেখ হাসিনাকে বার বার হত্যার টার্গেট করছে। ফলে বিরোধী দলে থাকার সময় ও রাষ্ট্রীয় দায়েত্বে আসার পরও তাকে মৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অন্তত ১৬ দফায় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আমি সব হারিয়েছি। আর হারাবার কিছু নেই। আমার বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো আমাকেও হত্যা করা হবে। তবে জীবন দেওয়া ও নেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। মৃত্যুভয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ থেকে সরে দাঁড়াব না। তবে ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট গ্রেনেড ভয়ঙ্কর ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি। গ্রেনেড হামলার ভয়াবত মর্মস্তদ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়া করে। ওই গ্রেনেড হামলায় স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কয়েকটি অনুষ্ঠান ২১ আগষ্টের প্রেনেড হামলার বেশ কয়েক দফায় নিজের প্রাণনাশের অপচেষ্টার ঘটনা তুলে ধরে বলেছেন, আমার পরিণতি বাবার মতো হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে আমাকে মাইনাসের চেষ্টা হয়েছে । জানি না, আল্লাহ কেন ইচ্ছাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও দলের প্রধান শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টার ঘটনায় বেশ উৎকন্ঠিত। বিরোধী দলে থাকাকালে এ নিয়ে দলীয়ভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছিল। বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল বুলেট প্রুফ গাড়ি; কিন্তু সেই নিরাপত্তা বেষ্টনীও টেকেনি। নিরাপত্তা কর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দেন।
কেন এখনও ঘাতকের টার্গেট শেখ হাসিনা, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালের ঘৃণিত ঘাতকরা তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার অংশ হিসেবেই গ্রেনেড হামলাসহ দফায় দফায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রাণনাশের অপচেষ্টা করেছে। প্রতিবারই মহান আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন। এখন তিনি জনতার শক্তি নিয়ে নিরাপদ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করছেন। দলটির উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়ের আহমেদ বলেন, অসীম সাহসের ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসির দন্ড কার্যকর করছেন। তার যোগ্য নেতৃত্বের কারণে জঙ্গি অপশক্তির তৎপরতা বিনাশ হচ্ছে। আর এসব অশুভ ঘাতক চক্রের পথের বাধা শেখ হাসিনা। তবে জনগণ তার সঙ্গে আছে। আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, মহান আল্লাহর রহমত ও নেতাকর্মীরা মানব ঢাল তৈরী করে ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সভাপতিকে বাঁচিয়েছেন। কেউ তাকে ফেলে পালাননি। এই কর্মী ও নেতারাই শেখ হাসিনার ভরসা। সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও একাত্তরের খুনিদের দন্ড কার্যকর করেছেন শেখ হাসিনা। এই ঘাতকদের বিচার করে অসাধ্য কাজটিই সম্পন্ন করেছেন। তাই শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সতর্ক রয়েছে। সভাপতিমন্ডলীল অন্য সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি এখনও শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। তবে ইনশাআল্লাহ, ওই অপশক্তির চক্রান্ত সফল হবে না। বাংলার মানুষ তাদের রুখবেই। তিনি আরও বলেছেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা বাস্তবায়নের অন্তরায় হয়ে আছেন বলেই শেখ হাসিনা বার বার খুনি চক্রের টার্গেট হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো তার বাবা হত্যার বিচার করেননি। খালেদা জিয়াও তার স্বামী হত্যার বিচার করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। এ কারণেই তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ভয়ের সাধ্য নেই শেখ হাসিনাকে ভয় দেখায়। নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি ভারমুক্ত।
হত্যাচেষ্টা ১৬ দফায়: ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী অবরোধ চলাকালে সচিবালয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে শহীদ হন যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারী চট্টগ্রামেও হত্যার চেষ্টা হয়। ওই দিন আওয়ামী লীগ সভাপতির গাড়ীবহরে গুলি করা হলে শহীদ হন ২৪ নেতাকর্মী। একই বছরের ১৫ আগষ্ট ও ১৯৮৯ সালেল ১১ আগষ্ট ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডীর গ্রিন রোডে পরিবার পরিকল্পনা ভোটকেন্দ্র পরিদর্শকালে গুলিবর্ষণ করা হলে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে হত্যার চেষ্টা হয়। ট্রেনে গুলিবর্ষণের পর তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি প্রাণে বাঁচেন। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কোয়ারে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার সনময় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে অস্ত্রধানীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার কাছে পুঁতে রাখা হয় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা; কিন্তু আগেই বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় রক্ষা পান প্রধানমন্ত্রী। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। ঘাতক চক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখেছিল। ২০০১ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িতে হামলা চালানো হয়। ২০০৩ সালের ৩০ আগষ্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গাড়ির বহরে গুলিবর্ষনের ঘটনায় প্রাণে বাঁচেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে ঘাতকের বুলেট থেকে তিনি রক্ষা পান। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই অন্যায়ভাবে বিনা ওয়ারেন্টে সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সাব-জেলে রেখে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যার অপচেষ্টা হয়েছিল। এছাড়াও ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও তৎকালীন মহাজোট সরকারকে উৎখাত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিল। ২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম লে. কর্ণেল (অব.) এহসান ইউসুফের ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করা তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীতে বিৃশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অভ্যুত্থানের প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা।
নিরাপত্তা: প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সরকারিভাবেও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। বাসভবনের ভেতরে কয়ের স্তরের নিরাপত্তায় মূল দায়িত্ব পালন করছেন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) ও প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) দক্ষ ও চৌকস সদস্যরা। এ ছাড়া সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো অনুষ্ঠান ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরী করা হচ্ছে।