কুমিল্লা প্রতিনিধি॥ দেশের প্রাচীন চারটি পৌরসভার মধ্যে একটি কুমিল্লা। বাকি তিনটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগ হয়েছে অনেক আগেই। ময়মনসিংহ বিভাগও ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাচীন শহর কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার দাবি রাখে এ কারনে। ১৯৬২ সালেই কুমিল্লাকে বিভাগ করার কথা ছিল। সব আয়োজন চুড়ান্তও হয়েছিল। কিন্তু কুমিল্লার পরিবর্তে তখন করা হয় চট্টগ্রামকে। কুমিল্লাকে দেয়া হয় শিক্ষা বোর্ড। সেই বোর্ড ভেঙ্গে তিন টুকরো করা হয়। অর্থ শতাব্দি ধরে বঞ্চিত কুমিল্লাবাসীর বঞ্চনার ইতিহাস ঘুছাতে বিভাগ হওয়ার যুক্তিযুক্ত। কুমিল্লা অঞ্চল (কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, লক্ষিপুর, নোয়াখালী) জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯শ ৭০ জন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৫৬ লাখ ২ হাজার ৬শ ২৫ জন অধিবাসী। জনসংখ্যার ভিত্তিতে কুমিল্লাকে বিভাগ করা জরুরী। কুমিল্লা পদ্ধতির দেখানো পথে কৃষিখাতে উন্নতি করায় বাংলাদেশ আজ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ। একারণে কুমিল্লাকে বিভাগ করার দাবী রাখে।
প্রকৃতির ক্ষেত্রে কুমিল্লা গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। লালমাই ময়নামতি অঞ্চলে আবিস্কৃত প্রত্মতাত্বিক নিদর্শন বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসের এক গৌরবময় ঐতিহ্যের সন্ধান দিয়েছে। এসব প্রাচীন কীর্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে কুমিল্লা অঞ্চলের সুমহান অবদানের কথা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে। ১৯৫৫-৫৬ সালে খনন করে প্রাচীন কৃর্তির ৫৪টি নির্দশন আবিস্কার করা হয় যা আমাদের জাতীয জীবনে পরম সম্পদ ও পরম গৌরব বস্ত। শিক্ষা ক্ষেত্রে কুমিল্লার অবদান গর্ব করার মতো। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দিতে কুমিল্লার দেবীদ্বারের গুনাইঘরে আশ্রম বিহার ও রাজ বিহার নামে দুটি বিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখানে শিক্ষালাভ করতেন। কুমিল্লা তথা সমতট রাজ্যে সপ্তম শতাব্দিতে ত্রিশটির বেশি বৌদ্ধ বিহার ছিল। সমতটের ব্রাহ্মণ রাজবংশে জন্মগ্রহণকারী শীলভদ্র জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ও সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন। তার জন্য বাঙালী জাতির মুখ উজ্জল হয়। তারই অব্যাহত ধারাবাহিকতা কুমিল্লা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে আসছে। ১৮৮৩ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বেগম রোকেয়ার জন্মের ৯ বছর আগে কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজি স্কুল। ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের অক্সফোর্ড খ্যাত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। কুমিল্লা জন্মদিয়ে যাচ্ছে অনেক কৃতী শিক্ষক ও ছাত্র। এ কারণে কুমিল্লা বিভাগ হতে পারে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে সমগ্র উপমহাদেশে কুমিল্লা অনন্য স্থান দখল করে আছে। এই কুমিল্লা কৃতীসন্তানরা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রাচীন শহর কুমিল্লাকে সার্ক সংস্কৃতি রাজধানী করার বিষয়টি বিবেচনাধীন। অনেক কীর্তিমান জন্মেছেন এই কুমিল্লায়। প্রতি শতাব্দিতেই কুমিল্লায় জন্মেছেন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব। জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচর্য শীলভদ্র, বাংলা সাহিত্যের প্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস লেখক দীনেশচন্দ্র সেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত। ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থানের কাণে কুমিল্লা বিভাগ হওয়া যুক্তিযুক্ত। চতুর্থ শতাব্দির স্তম্ভ লিপিতে উল্লেখ পাওয়া সমতট রাজ্যের কেন্দ্র ছিল ত্রিপুরা বা আজকের কুমিল্লা। পঞ্চদশ শতাব্দিতে গুপ্ত সমতটদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আসা কুমিল্লা অঞ্চলের মহারাজা রুদ্র দত্ত ও মহারাজা বিজয় সেন নামে দুই সামন্ত অর্থরক্ষক ও শান্তি রক্ষক ছিলেন বলে প্রমান পাওয়া গুপ্ত স¤্রাটদের যুগ থেকে কুমিল্লার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব অপরিশীম বলে প্রতীয়মান হয়। কুমিল্লা সে সময় সুনিদ্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত না থাকলেও ১৭৮১ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যে প্রশাসনিক অঞ্চল কাঠামো প্রস্তুত করে তাতে কুমিল্লার ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারিত হয়। পার্বত্য ত্রিপুরার কুমিল্লা জেলা ও পাশ্ববর্তী আরো কিছু এলাকাকে ত্রিপুরা রাজ্য বলে তারা অবহিত করে। বর্তমান কুমিল্লা জেলার ৪২৬ বর্গকিলোমিটার ও নোয়াখালী জেলার ১০২ বর্গকিলোমিটার এলাকা রওশনাবাদ চাকলার অন্তর্গত ছিল। কুমিল্লা জেলার উত্তর মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চল নিয়ে রওশনাবাদ চাকলা গঠিত হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৯ সালে মিডলটোন নামে একজনকে ঢাকা প্রদেশের তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। কুমিল্লার জালালপুর ছিল তার অধীনে। ১৭৭৬ সালে কুমিল্লাকে কালেক্টরের অধীন করা হয়। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা কালেক্টরেটের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ১৯৬০ সালে ত্রিপুরার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা। এর অধীনে দুটি মহাকুমা ছিল একটি চাঁদপুর আরেকটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ১৯৮৪ সালে চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আলাদা জেলা করা হয়। চতুর্থ শতাব্দি থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থানের গুরুত্ব পাওয়া কুমিল্লায় বিভাগ হওয়ার দাবি রাখে।