শাহরিয়ার ভাইয়ের ফেসবুক পেইজ থেকে সংকলিত॥ আমি তখন থাকি মুন্নার বাসায়, লালকুঠি, মাজার রোডে। একাউন্টিং পড়তে মৌচাকে যেতে হয় আমিরুল স্যারের বাসায়। খুব ভালো পড়াতেন স্যার। বেশীর ভাগ দিনই সিটি কলেজে ক্লাস শেষ করে সেখানে যেতাম, ফিরতাম মুন্নার বাসায়। একেক দিন একেক বাহন। মাসের শুরুতে দুই-একদিন স্কুটার/বেবি টেক্সি, তারপর টেম্পু, তারপর বাস। একবার দুই বন্ধুতে তর্ক। সাইন্সল্যাব থেকে গাবতলি মাজার রোড বাস যে সময় নেয়, একই সময়ে রিক্সাও যেতে পারে। একদিন রিক্সায় চেপে কাছাকাছি সময় একটা ছেড়ে যাওয়া বাসকে অনুসরন করে সেই ‘হাইপোথিসিসের’ সত্যতা পাওয়া গেলো।
একদিন পত্রিকায় দেখলাম বিআরটিসির নতুন দোতলা বাস নেমেছে। তবে রুট গুলিস্তান টু মিরপুর ১০ নন-স্টপ। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলাম এই বাসে চড়তে হবে। কিন্তু ফুটবল খেলা না থাকলে (মিরপুরে তখন ফুটবল হতো, ক্রিকেট না) মিরপুর ১০ আমাদের জন্য বাড়তি পথ। গুলিস্তানও খুব একটা যাওয়া পড়েনা। একদিন খেয়াল করলাম ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমার সামনে দোতলা বাসটা একটু স্লো হয়। ঠিক করলাম এখানেই চান্স নিতে হবে। একদিন মৌচাক থেকে টেম্পুতে ফার্মগেট ফিরলাম। অপেক্ষায় আছি কখন লাল দোতলা বাস আসবে। আসলো একটা, একটু স্লো হলো ঠিকই কিন্তু ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে পারলাম না। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা, গল্প, মানুষ দেখা। কথার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক পরিকল্পনা কিভাবে এবার উঠবো, তবে উঠবই। কোথায় থামলে কোন দিক দিয়ে দৌড়ে বাসের কাছে সবার আগে যাবো, এইসব।
দীর্ঘক্ষণ পর বাস আসলো। দৌড়ে বাসের কাছে গেলাম। কিচ্ছু মনে নেই, শুধু বাসটা যখন আবার পূর্ণ গতিতে তখন খেয়াল করলাম, আমার বাম পায়ের পাতা পাদানির কোনা ছুয়ে আছে, আর বাম হাত দিয়ে বাম পাশের ব্যাক লাইটের পাতলা লোহার রডের কাভারটা ধরা। পাদানিতেই এতজন দাঁড়িয়েছে যে আমার ডান পা বা ডান হাতের নাগালে কিছু নেই।
সংসদের মোড় ঘোরার আগেই আমি চিৎকার জুড়ে দিলাম বাস থামানোর জন্য কারন ততক্ষণে আমি নিশ্চিত আমি এইভাবে আর এক সেকেন্ডও টিকে থাকতে পারবোনা। বাস থামাতো দুরের কথা, রোকেয়া স্মরণিতে বাস উঠেই আরও জোরে চলা শুর করলো। আমি তখনও এক পা আর এক হাতের উপরেই! একবার ভাবলাম ঝাঁপ দিয়ে নেমে যাই কিন্তু বিচার বিবেচনা যা অবশিষ্ট ছিলো তাতে মনে হলো নিশ্চিত একটা বড় দূর্ঘটনা অপেক্ষা করছে। বাস তখন হু হু করে চলছে। চিৎকার করা তখন বন্ধ। ভয়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা। দোয়া দরুদ যা যা জানা ছিলো পড়া শুরু করেছি। হঠাৎ ডান দিকে তাকিয়ে দেখি বাসের নিচের দিকে একটা খোঁপ মত, ব্যাক লাইট বরাবর। পা দিয়ে খুঁজে দেখি বাম দিকেও একটা আছে। কোন মতে ডান পা টা ওখানে রাখলাম। আর দুই হাতের আঙুলগুলো দিয়ে পালা করে ব্যাক লাইটের খাঁচার মত কাভার ধরে থাকলাম। ভয় হচ্ছিলো খাঁচাটা যদি খুলে যায়!
মিরপুর ১০ এসে বাস থেকে নামলাম। দুই হাতে প্রচন্ড ব্যাথা। পাদানিতে থাকা দুই-একজন মৃদু ভৎষনা করলেন। নেমে দেখি মুন্না নাই। রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। মুন্না ফিরলো আরও পরে। কিছুক্ষণ ঝগড়া চললো, আমি বললাম আমাকে নেমে যেতে বললিনা কেন? ও হয়তো বলেছিলো, আমি শুনতে পাইনি। দুই হাতের এলবোতে ব্যাথা প্রায় সপ্তাহখানেক ছিলো।
এরকম কাছাকাছি দৃশ্য এখনও অহরহ দেখা যায়। এই ছবিগুলো আজ সকালে এয়ারপোর্ট রোডের। যদিও আমার সেইদিন ঐভাবে বাসে চড়া মোটেই ঠিক হয়নি কিন্তু মানুষকে নিতান্তই প্রয়োজনের তাগিদেই ঝুকি নিয়ে চলতে হয়। সবাই নিরাপদে যাতায়ত করার চেষ্টা করবেন।