মাসুদা ভাট্টি॥ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। উপমহাদেশের এই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি নতুন একজন সাধারণ সম্পাদক পেয়েছে এবং একজন ‘নতুন’ সভানেত্রীও পেয়েছে কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো এই কাউন্সিলের ভেতর দিয়ে দেশের মানুষ (এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দলও) পেয়েছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা। আজকের লেখার বিষয় এই বার্তাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, এই কাউন্সিলের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ একজন নতুন সাধারণ সম্পাদক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে একজন সভানেত্রীও পেয়েছেন, তাকে নতুন সভানেত্রী বলেছি। কেন বলেছি, সেই ব্যাখ্যাটি দেওয়া উচিত বলে মনে করি। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলকে কী দিয়েছেন সেটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভালো বলতে পারবেন। আর দেশকে তিনি কী দিয়েছেন একজন নাগরিক হিসেবে সেটি আমাদের বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এবিষয়ে বিস্তারিত আরেকদিন আলোচনার জন্য তুলে রেখে শুধু একথাটিই বলতে চাই যে, বাংলাদেশ আজকে যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তার মূল রূপকার মূলত শেখ হাসিনা। যারা এই সত্যটি মানতে চান না, তারা হয় জ্ঞানপাপী, নয় সত্যকে স্বীকার করতে ভয় পান। কিন্তু এই কাউন্সিল চলাকালে শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তাকে আসলে ‘নতুন’ সভানেত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় কারণ তিনি অত্যন্ত বেছে বেছে শব্দচয়ন করে এই বক্তব্য দিয়েছেন, যে সব উন্নয়ন-কাজ করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এবং সামনে কী ধরনের কাজ করতে চান তা স্পষ্ট করেছেন।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো তিনি তার বক্তব্যে কাউকে দোষারোপ না করে সামনের নতুন- রাজনীতির কথা বলেছেন। আরো বড় বিষয় হলো, তিনি দলকে, দলের নেতাকর্মীদের নিবার্চনমুখী করে তুলেছেন এবং দেশবাসীকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন। যদিও আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্বাচন প্রবণতা নতুন কিছু নয়, যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এতো সমালোচনা সেটিও আওয়ামী লীগ কোনো নেতিবাচক উদ্দেশ্য থেকে করেছে বলে প্রমাণ মেলে না। বিশেষ করে বিএনপি’র নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাটাই যে সেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সেকথা আমাদের মেনে নেওয়ারও সময় এসেছে এখন। মজার ব্যাপার হলো, সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিল অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন বিশেষ করে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, বিএনপি মহাসচিব তার কঠোর সমালোচনা করে এই বক্তব্যকে অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ইত্যাকার রাজনৈতিক ‘অশ্রাব্য’ বাক্যমালা আমাদের শুনিয়েছেন। ভদ্রলোক ভুলে গেছেন যে, বিএনপি নেত্রী ও তার সুপুত্র তারেক রহমান প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে আগামী ৫০ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে দেবেন না।
মির্জা ফখরুল নিঃসন্দেহে তার নেত্রী ও পাতি- নেতার এই বক্তব্যকে অগণতান্ত্রিক মনে করেন না, মনে করেন শেখ হাসিনার বক্তব্যকে যেখানে তিনি দলকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য নেতাকর্মীদের নির্বাচনকে লক্ষ্য করে রেখে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি গণতান্ত্রিক চরিত্রের রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে কাজ করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া কবে থেকে এবং কোন্ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্রে অগণতান্ত্রিক ও ভয়াবহ হলো, সে প্রশ্ন কোনো সাংবাদিক তাকে করেননি বা করার সুযোগ পাননি, কারণ, বিএনপি’র কোনো নেতানেত্রীই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন না, এমনকি কোনো প্রশ্নও নেন না। তারা বলতে ভালোবাসেন, তাই বলেছেন। মজার ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনা এই কাউন্সিলের মাধ্যমে যে নির্বাচনী বার্তা দিয়েছেন তার নেতাকর্মীদের তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের ২০-তম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন নিয়ে কোনো কথা না বলে বরং আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো’তে কাউন্সিল ও কাউন্সিল-পরবর্তী আলোচনায় আগামী নির্বাচন নিয়েই আলোচনা চলছিলো। বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদকের কাছে তাদের আশাবাদ ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠার কথা শুনিয়েছেন।
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শেখ হাসিনার এই বক্তব্যটিকেই স্বাগত জানাচ্ছেন যে, শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নয়, তিনি একটি প্রশ্নহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে চান, এবং দেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। আমি জানি না, এরকম একটি রাজনৈতিক আশাপ্রদ বক্তব্য গত কয়েক দশকে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের শুনিয়েছেন কিনা, এমনকি শেখ হাসিনা নিজেও আগে কখনও এভাবে বলেননি। আর সে কারণেই সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিলে তিনি আওয়ামী লীগের ‘নতুন’ সভানেত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বলে আমি মনে করি। হ্যাঁ, সমালোচনা করতে চাইলে এই কাউন্সিলেরও অনেক সমালোচনা সম্ভব। বিশেষ করে দলের ভেতর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার যে পুরোনো অভিযোগ তা আমরা করতেই পারি। কিন্তু একথাও কি সত্য নয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের ভেতরও আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চেয়ে রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ (টোটাল সাবমিসন)-এর রীতিটিও ঐতিহাসিক ও পুরোনো? নাহলে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে একজন নেতাকর্মীও কি ‘নির্বাচনের দাবীটি’ তোলার সাহস দেখাতে পারতেন না? নাকি সকলের মুখই দল থেকে চাপ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করবো? মিডিয়ার পক্ষ থেকেতো এই কাউন্সিল তথা আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা কম হয়নি, তাই না? কিন্তু আমার মনে হয় দলের ভেতর নির্বাচন প্রক্রিয়ার চাইতে একজনকে নেতা ‘সিলেক্ট’ করে তার হাতে সকল দায় ও দায়িত্ব তুলে দিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীরাও নিজেদের ভারমুক্ত রাখতে চান। কারণ, বলাতো যায় না, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ভুল কাউকে নির্বাচিত করা হয়? যদি তার হাত দিয়ে দল ও সরকারের বৃহৎ কোনো ক্ষতি হয়? এরকম সম্ভাবনাতো থেকেই যায়। তার মানে এই নয় যে, চলমান প্রক্রিয়ায় যিনি দলের নেতৃত্বে আসেন তার কোনো ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তারও থাকে কিন্তু সে ক্ষেত্রে দোষ চাপানো যায় নেতার ওপর। যেমনটি অতীতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকেও এই দোষে দোষী সাব্য¯স্ত হতে হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে ভবিষ্যতে হতে হবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎই বলবে কিন্তু এর আগে যে শেখ হাসিনা সঠিক ব্যক্তিকেই দল পরিচালনায় তার ‘রানিং মেইট’ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
প্রয়োজনে কঠোর হওয়া এবং সকল সময় সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে দল পরিচালনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সময়কালে পছন্দ করা সকল সাধারণ সম্পাদকই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা আশা করতেই পারি যে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নতুন ‘রানিং মেইট’ ওবায়দুল কাদেরও আওয়ামী লীগের অতীত সাধারণ সম্পাদকদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাটি বজায় রাখবেন। দেশের মিডিয়ার নেতৃস্থানীয়রা কাউন্সিলের শুরু থেকেই যাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার কথা বলে আসছিলেন তিনিই সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, সেদিক থেকে মিডিয়ার ‘দূরদৃষ্টি’ প্রশংসা পাবার যোগ্য কিন্তু একই সঙ্গে বেশিরভাগ মিডিয়াই ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনার পারিবারিক সদস্যদের বিশেষ করে পুত্র ও আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়-এর দলে বড় পদে আসীন হওয়ার আগাম খবরও প্রকাশ করে আসছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রে মিডিয়ার ‘দূরদৃষ্টি’কে ভুল প্রমাণিত করে জয় নিজেই বলেছেন যে, তিনি এখনই কোনো পদ চান না, তিনি কাজ করতে আগ্রহী, তিনি কাজ করতে চান। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসা আমাদের করা উচিত। কারণ, তিনি অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মতোই কেবলমাত্র নেতৃত্বে থাকার কারণেই দলের ভেতর পরিবারের সদস্যদের পদ পাইয়ে দিয়ে দলকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেননি। বরং তৃণমূলে কাজ করিয়ে রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েই সকলকে দলে ঠাঁই দেওয়ার বার্তাটি সকলকে দিয়েছেন। দলের প্রেসিডিয়ামে এখনও যে সব পদ খালি রয়েছে সেসব পদের কোনোটিতে যদি তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানাকে জায়গা করে দেন তাহলেও আমাদের বলার কিছু থাকবে না কারণ শেখ রেহানা এতোকাল ধরে রাজনীতির অন্তরালে থেকেও যে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা অর্জন করেছেন তাকে খাটো করে দেখার কোনোই অবকাশ সেই। আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ভাবেই চমক সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল, দেখা যাক আমাদের জন্য আর কী কী চমক অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু শেষ করতে চাই শেখ হাসিনার নির্বাচনী বার্তাটি দিয়েই। সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যা পাবার তা পেয়েছে কিন্তু আগেই বলেছি যে, দেশবাসী পেয়েছে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন আশাবাদ। কেবল বিএনপি’ই যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগের জায়গাটিতে রয়ে গেছে তা আবারও প্রমাণ করেছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যটি, যাতে তিনি শেখ হাসিনার নির্বাচনে জয় লাভের ইচ্ছাতে ভয় পেয়েছেন বলেই উল্লেখ করেছেন।
বলাই বাহুল্য যে, এই ভয়ের কারণ শেখ হাসিনার বক্তব্য নয়, এই ভয়ের কারণ হলো, তারা এখনও নির্বাচনের জন্য কোনো ভাবেই প্রস্তুত নয়, সে কারণেই তার এই ভয়। কিন্তু বিএনপি’র ভয়ের কারণে দেশ, জাতি, নির্বাচন কোনোটাই যে অপেক্ষা করবে না সে বার্তা তারা যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিও না পেয়ে থাকেন তাহলে বলার কিছু নেই, কারণ মানুষ কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে এবং তারা পরবর্তী একটি সাধারণ নির্বাচনের যে বার্তা শেখ হাসিনা দিয়েছেন তা নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। যে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্মেলনের মাধ্যমে নেতাকর্মীকে উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনমুখী করাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য হিসেবে পরিগণিত হয়, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সেটিই করেছেন। এতে বিএনপি’র সত্যিই ভয় পাওয়ার কথা এবং সেই ভয়টাই তারা পেয়েছে।