ঐতিহাসিকভাবে ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক বিবেচনা করলেও বলা যেত সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ অথবা সহাবস্থানের দেশ বাংলাদেশ। কি এমন ঘটল যে দিনকি দিন এই সম্প্রীতি বিপন্ন হতে চলেছে। ধর্মান্ধতাই কি এর মূল কারণ না সু-শিক্ষার স্থলে কুশিক্ষার প্রভাবই এর কারণ তা এখন গভেষণার বিষয়। কারণ আগামীর সুন্দর বাংলাদেশের জন্য এবং এর অতীত ঐতিহ্য ও সুনামকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা আমাদের কাম্য। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ধর্মান্ধতা ছিলো আছে এবং থাকবে। কিন্তু এর মধ্যেও সকল ধর্মের সহাবস্থান ছিল বিরাজমান। যা বেশীদিন নয় আজ থেকে ৪৬ বছর আগেও দেখেছি গভীর বা বাঙ্গালীর নাড়ীর সঙ্গে সকল ধর্ম-বর্ণ এবং গোত্রের সহাবস্থান জড়িয়ে ছিল। ধর্মের বেড়াজাল দিয়ে কেউ কাউকে পর ভাবার কোন সুযোগ ছিল না। যদিও গোড়ামীর কারণে কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি কিন্তু তা বেশীদিন টিকেনি। বরং সম্প্রীতির মানবীয় ভালবাসাই সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে। একটি গটনা বলি যখন আমি ১-৫ শ্রেণীতে পড়েছি তখন দেখেছি সম্প্রীতি কাকে বলে। যেমন হিন্দু-মুসলীন সম্প্রীতি। রোজা, নামাজ, ঈদ পার্বন কোনটিতেই হিন্দু প্রতিবেশী এবং বন্ধ-বান্ধবগণ অনুপস্থিত এমন নজীর দেখিনী পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় রীতির মধ্যেও আমরা পেয়েছি আনন্দ। তবে কখনো আমাদের এবং কখনো তাদের ধর্মীয় কিছু রিতির দুরত্ব বা ফারাক রয়েছে যা আমরা পাশ কাটিয়ে গেছি। মনে পড়ে আমার এক বন্ধুর মা খুতখুতের কারণে আমি ঐ ঘরে প্রবেশ করিনি কোনদিন। কারণ একদিন ওদের ঘরে গিয়ে পানির কলসি ধরে পানি খেলে সেই সময় সাথে সাথে বন্ধুটির মা এসে সমস্ত পানি ও কলসিটি ভেঙ্গে ফেলে। কারণ জানতে চাইলে বলে ছুইত লাগছে বা ঘর অপবিত্র হয়ে গেছে এবং সবকিছু ফেলে দিতে হয়েছে। তাদের ঐ ধর্মীয় অন্ধত্বকে আমি এখনও সম্মান করি। কিন্তু পাশাপাশি সকলের বিশেষ করে ২০টি পরিবারের সকলের ঘরের খাবার এবং এমন কোন জায়গা ছিলনা যেখানে আমার স্পর্শ লাগেনি। এমনকি একদিন না গেলে ওদেরই ভাল লাগত না। যখন আমি নামাজ পড়ছি আমার হিন্দু বন্ধু নামাজ পড়ছে। সে শিখেছে সুরা ও নিয়ত। এই যে যার যার ধর্ম পালনের সম্প্রীতি এবং সবকিছুর উদ্ধে মানবীয় ভালবাসায় জয়ী ছিল তা আজ কোথায়? যে বন্ধুটির মা ঐদিন কলসি ভেঙ্গে সবকিছু ফেলেছিল সেই মায়ের পাশে যখন প্রয়োজনে দাঁড়াতাম তখন তিনি সেই অনুতপ্ত ও নতমনে কাছে টানতেন। আমাকে অনেক ভালবাসতেন। সেই ভালবাসায় ছিল না কোন খোঁত বা ধর্মান্ধতা। আজও মনে পড়ে কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এবং যোগাযোগের অভাবে এখন শুধুই স্মৃতিপটে রয়েছে।
আমাদের সরকার দেশ ও সংস্কৃতিতে নেই কোন ভেদাভেদ এবং একে অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা। কিন্তু কেন মাঝে মাঝে শুনতে ও দেখতে হয় আমাদের হীনমন্নতা এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান কাজ। এইতো সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়া ঘটে যাওয়া ঘটনা তারই প্রমান। কি ছিল এর পেছনের গল্পে। একই সমাজে বা পরিবারে বাস করতে গেলে পাতিলে পাতিলে টক্কর লাগতে পারে কিন্তু এমন নৈরাজ্যজনক মনুষত্যহীণ কাজ। এই কাজের পেছনে রয়েছে কোন উদ্দেশ্য এবং এই কাজ যারা করেছে তারাতো নিজেরাই ধর্মীয় আদেশ ঠিকভাবে পালন করেন না বরং হুজুগে ধর্মকে ব্যবহার করেন। একটি প্রবাদ আছে বাঙালী হুজুগে পাগল বা জেগে উঠে। এই প্রবাদটির পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, যেমন চিলে কান নিছে তাই চিলের পিছনে দৌঁড়াচ্ছি কিন্তু কানে হাত দিয়ে দেখেনি। যখন দেখেছি তখন সময় শেষ হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতি এবং শিক্ষার মাঝে এখনও যে ফারাক রয়েছে তা দুর করার দায়িত্ব সকলের, সরকার বা প্রশাসনের একার নয়। প্রশাসন বা সরকারকে দোষ চাপিয়ে নিজেরা পার পেয়ে যাওয়া স্বভাবের মধ্যথেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা এইসকল সহজ-সরল ধর্মান্ধ মানুষগুলিকে ওষ্কে দেয় তাদের সম্পর্কে ভাবুন। তাদের অতীত, বর্তমান নিয়ে চিন্তা করুন। দেখুন তারা মানুষের কল্যাণে বা প্রয়োজনে কোন সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে কিনা; নাকি দারিদ্রের যা আছে তা নেয়ার জন্য ধর্মীয় লেবাস ধরে বিভিন্ন কৌশলে ফন্দি ফিকির করে হাতিয়ে নিচ্ছে শেষ সম্বলটুকু। আগেকার দিনের মানুষগুলির ছিলনা এত শিক্ষা কিন্তু ছিল সম্প্রীতির দিক্ষা এবং শান্তির স্থিরতা। ছিলনা তাদের লোভ এবং হিংসা। কারণ তারা ধর্মদিয়ে মানুষকে আলাদা করত না বরং ভাবত সবাই আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মাকলুকাত এবং যার যার ধর্ম তার কাছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে একযোগে কাজ করছে। আগের মানুষগুলি যখন এগুলি পেরে এসেছে তাহলে এখনকার সভ্য সমাজের উন্নতির সোপানের শিক্ষিত মানুষগুলি কেন পারবে না। পারবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই। মানুষের ওয়াল্ড ভিউ জাগ্রত এবং বৃদ্ধিকল্পে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সম্মীলন ও প্রত্যেকের নিজ দায়িত্বটুকু সততার সঙ্গে পালনের মাধ্যমে।
সরকারের গৃহীত কর্মসূচীগুলি গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে দিয়ে কুসংস্কার ও অন্ধকারাছন্ন জায়গায় জ্ঞানের আলোর দীপশিখা জেলে আমরা প্রত্যেকে নিজে আগে পরিবর্তন হওয়ার অঙ্গিকার করি। তাহলেই দেখব আনাকাঙ্খিত ঘটনার পরিসমাপ্তি। আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যায় মস্তীষ্ক বিকৃত কাজ যা ঘটছেই থামছে না । এর কারণ কি? উক্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানী, রেইপ করার মত ঘটনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বুঝতে কষ্ট হয়ে এই ভেবে যে ইহা কোন শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ নেই। এর ব্যপ্তি এখণ সমাজের নি¤œস্তর থেকে শুরু করে জ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। লজ্জা রাখি কোথায় যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মসজিদ-মাদ্রাসার হুজুর শিক্ষক এমনকি বস্তির অশিক্ষীত মাস্তান। আরও গভীরে গেলে সমাজের উঁচু শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ বণিতাদের এই হীণ কর্মের দায় থেকে মুক্তির উপায় কি? আমাদের সামাজিক মুল্যবোধ, সকল ধর্মের ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো কোথায়। কেন মুল্যবোধহীন জীবনের এই পদচারণা। আমরা কি হারিয়ে যাওয়া মুল্যবোধগুলি পুনরোদ্ধার করে চর্চা করতে পারি না। কোন কিছু ঘটলেই বিচার এবং ফাসি চাওয়াতেই সব শেষ। আমি মনে করি না। কারণ এর পেছনের গল্প বা কারণ উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় সংস্কার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সমাজ থেকে এই ব্যধীর বিলুপ্তী ঘটবে। নতুন দিনকি দিন এইসব দেখে বিবেকের ধংশন শয্যকরে যেতে হবে। আমি মনে করি এখন সময় গবেষনা এবং সংস্কার ও পরিচর্যা করার। যারা ভিকটিম উভয়ের সঙ্গেই কাউন্সিলিং করে আগামীর সম্ভাবনা নিশ্চিত করা।
আগাম নির্বাচনা বা নির্বাচন কমিশন নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা কথাবার্তার পরিসমাপ্তি ঘটলে ভাল হয়। কারণ উত্তপ্ত মরুময় শুন্য জায়গায় ফাকা বুলি আওড়িয়ে এখন আর রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। এখন যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা ও কাজের সমন্বয় ঘটানোর উপযুক্ত সময়। ডিজিটাল পদ্ধতির প্রর্বতনে আমাদের সবকিছুই এখন পরিবর্তিত হচ্ছে তাই মান্দাতার আমনের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার অবসান হউক। এটাই আমাদের কামনা। বিগত আঠটি বছর সেই মান্দাতার আমলে ধ্যান ধারনার পরিণতি যে আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা উপলব্দি না করতে পারলে আরো সমূহ বিপদ আগামীর জন্য অপেক্ষা করছে। ৭ নভেম্বর এর কর্মসূচী নিয়ে বিএনপি যে বড় গলায় কথা বলছে তা আসলে ঠিক নয়। এই সময় তাদের ধৈর্য দরে অনুধাবন করা উচিত দেশবাসী বা জনগণ কি চায়। ৭ নভেম্বর এর অনুষ্ঠান এর প্রয়োজনীয়তা দেশীয় বা দলীয় পরিমন্ডলে তেমন কোন ফায়দা বা ইতিহাস পুনরাবৃত্তির নয়। বরং বিতর্কীত একটি দিন এবং এই দিন দেশের ইতিহাসের কলঙ্ক বৈকি আর কিছু নয়। তাদের এই মিথ্যার গলাবাজি থেকে বের হয়ে আসার এখনই উপযুক্ত সময়। আসুন আমরা সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিকে মনযোগ দেই। এই সম্প্রীতিই হউক আমাদের পাথেয়। জীবন চলার পথের, কর্মক্ষেত্রের, পরিবারের, সমাজের, রাজনীতির এমনকি সকল ক্ষেত্রের মাপকাঠিই হউক সৌহার্দ-সম্প্রীতি এবং সকলের সহাবস্থান।