বাআ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করার আহবান জানিয়ে বলেছেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ৪৫তম জাতীয় সমবায় দিবস উদযাপন এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার-২০১৪ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। সমবায় অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে সমবায় আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, আমি আশা করি সমবায়ের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা সকলেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। যেহেতু এটা জাতির পিতারই একটা আকাঙ্খা ছিল- তিনি বহুমুখি গ্রাম সমবায় করতে চেয়েছিলেন। ’৭৫’র ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যা করার পর সেটা আর করা হয়নি। আমরা তাই ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে বহুমুখি কর্মসূচির মাধ্যম তাঁরই সেই পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সফল হতে পারে। আমি আশা করি, আপনারা সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় সংসদের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং এলজিআরডি ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব ড. প্রশান্ত কুমার রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন- সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো.মফিজুল ইসলাম এবং সমবায় ইউনিয়নের সভাপতি ও মিল্কভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু। অনুষ্ঠানে ১০টি ক্যাটাগরিতে ৫ জন ব্যক্তি ও ৫টি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় সমবায় পুরস্কার ২০১৪ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তিবর্গ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাক্তিগণের মাঝে প্রধানমন্ত্র্রী এই পদক বিতরণ করেন।
পুরস্কার হিসেবে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের পদক এবং সনদপত্র প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। তিনি সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। আর সমবায় বৈষম্য হ্রাস এবং সমতাভিত্তিক সমাজের কথাই বলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ দেশ পুনর্গঠনকালেই জাতির পিতা সমবায়ের মাধ্যমে এ দেশের আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু কৃষি, ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প উদ্যোগ, কৃষি ঋণ বিতরণ- সকল ক্ষেত্রে সমবায় কৌশলকে কাজে লাগিয়ে স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি সংবিধানে সমবায়কে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতার ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণার একটি অংশের উদ্বৃতি তুলে ধরেন- ‘ গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে জমি নিয়ে যাব তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান-এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভ-এ জমির মালিকের জমি থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার দর্শনকে ধারণ করেই সরকার প্রতিটি গ্রামে সমবায় ভিত্তিক মৎস্য খামারসহ গবাদী পশু, হাঁস-মুরগীর খামার খামার গড়ে তুলছে। সামাজিক বনায়ন, সমিতির মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন, তাঁত ও সেলাই, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক প্রকল্প ও বাস্তবায়ন করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষিত-অর্ধ-শিক্ষিত বেকার ও কর্মক্ষম যুব সম্প্রদায়কে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পোল্ট্রি, কম্পিউটার, গবাদী পশু পালন, ক্যাটারিং, ড্রাইভিং, ফুল সাজানো, দর্জির কাজ, ব্লক-বাটিক ও স্ক্রীন প্রিন্ট ইত্যাদি কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পর সরকারী-বেসরকারী পুঁজির সহায়তায় সমবায়ের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমবায় একটি দর্শন। সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী কৌশল। যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শান্তির সমাজ গড়ে তোলা যায়। তিনি বলেন, ‘সরকার গঠনের পর আমাদের গৃহিত বাস্তবধর্মী নীতি-কৌশলের কারনে সমাজে বিদ্যমান ধনী-গরীবের বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশবিরোধী চক্র দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে রাজনীতির নামে দেশবিরোধী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নকে তারা পিছিয়ে দেয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়াম লীগ সরকার গঠনের পর সমবায়ে নতুন প্রাণ সঞ্চারের কর্মসূচী গ্রহণ করি। আমরাই সাধারণ সমবায়ীদের জন্য বাংলা ভাষাতে সমবায় আইন প্রণয়ন করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমবায় প্রসঙ্গে জাতির পিতা বলেছিলেন ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে উন্নত জীবনের অধিকারী হবে-এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরীব কৃষকেরা যৌথভাবে উৎপাদন ও যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই চিন্তা-চেতনার আলোকেই আমরা সমবায়কে বহুমুখী সমবায় হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের আলোকে বলেন, যৌথ ব্যবস্থায় চাষাবাদ করলে যেমন ভূমির অপচয় রোধ হবে তেমনি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। না হলে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমি ভাগ হতে হতে যে অবস্থায় পৌছাচ্ছে তাতে চাষের জমি আর থাকবে না। জমির আইলের জায়গাই একটি জেলার সমান হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা বলেন, কৃষি জমি নষ্ট করে কারখানা নয়, চাষ উপযোগী জমি সংরক্ষণ করতে হবে। পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর শিল্প কারখানা হবে নির্দিষ্ট জায়গায়। এ জন্য আমরা সারাদেশে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমাদের শিল্পায়নে যেতে হবে। যে অঞ্চলে বেশি কাঁচামাল পাওয়া যাবে সেখানে সেই শিল্প গড়ে তুলব। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাব।’ বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার জাতীয় সমবায় নীতিমালা ২০১৩ এবং সংশোধিত সমবায় আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এ বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে সমবায় ভিত্তিক ‘একটি বাড়ী একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। আর মাইক্রোক্রেডিট নয়, আমরা ক্ষুদ্র সঞ্চয় বা মাইক্রো সেভিংস’র ব্যবস্থা করেছি। গড়ে তুলেছি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। এ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৪০ হাজার ৫২৭টি সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমবায়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৮৭৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। গত ৭ বছরে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৭ হাজার ১২২টি পরিবারকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। দারিদ্র বিমোচনে সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা তো বলেছিলাম। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। আমরা মোবাইল, ল্যাপটপ, ইন্টারনেটসহ নানা উন্নত প্রযুক্তিতে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছি। গ্রামে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। আজকাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঘরে বসেই অনলাইনে তাদের পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করতে পারছে, জনগণ কিনতে পারছে। আজকাল কোরবানীর গরু ও অনলাইনে পাওয়া যায়, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সকল সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি বলেন, দেশে টেকসই সমবায় গড়ে তুলতে হবে। এলক্ষ্যে দক্ষ প্রশাসন, সৎ সমবায়ী নেতৃত্ব, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সমিতি ব্যবস্থাপনা এবং সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সমবায়ীদের সকল ধরণের সহযোগিতা প্রদান করবে।
শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি- ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।’ এলক্ষ্য অর্জনে তিনি সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।