রাইসলাম॥ মোহাম্মদ হানিফ, যার নামের সাথে মেয়র শব্দটি হয়ে ওঠেছে অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশবাসী তাকে মেয়র হানিফ নামেই চেনে। তিনি ঢাকা সিটি করর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একজন নন্দিত নায়কও তিনি। অনেক গুনগরিমার অধিকারী- বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের একান্ত সচিব, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ও ঘনিষ্ঠ সাহচর, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্নেহধন্য ও বিশ্বস্ত, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং সভানেত্রী শেখ হাসিনাবে গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষা করতে মানব ঢাল তৈরী করে আহত হওয়া একজন ব্যক্তি। আজ ২৮ নভেম্বর, এই জননেতা মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আবদুল আজিজ ও মুন্নি বেগমের পরিবারের কনিষ্ঠ ছেলে মোহাম্মদ হানিফ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর অসুস্থ অবস্থায় ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর ইন্তেকাল করেছিলেন।
মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে এইচএসসি ও বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন আইন বিষয়েও লেখাপড়া করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর দুর্দিনে তার পরিবারের পাশে দাড়ানোর মাধ্যমে নিজের ভক্তি ও ভালোবাসার জানান দেন মোহাম্মদ হানিফের পরিবার। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তখন ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রিপাড়ার বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার।
সেই সময় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের পরিবারকে তাদের পরিবারিক পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার বাসায় নিয়ে তোলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুও সেই বাসায় ওঠেন এবং পরিবার নিয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন।
সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। ফলে তিনি সবসময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কোনো দিন কমে যায়নি।
এক সময় ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনে তিনি রাজপথে সংগ্রামের প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব থেকে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মরহুম আলহাজ মাজেদ সরদারের কন্যা ফাতেমা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে (বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাইদ খোকন) ও দুই কন্যাসন্তানের জনক।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তার প্রতিদানের উপহার দেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে মোহাম্মদ হানিফকে জাতীয় সংসদের এমপি নির্বাচিত করিয়ে হুইপের দায়িত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে আওয়ামী লীগের ঘোর দুর্দিনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর এ গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন। এছাড়াও ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম সরাসরি নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ, মহিলাদের মাতৃকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ, ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলি বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্যবর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তিলোত্তমা নগরী গড়ার লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব, ঢাকাবাসীর কাছে নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হিসেবে এটাই তিনি কাজে প্রমাণ করে গেছেন।
একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিটি ক্রান্তিকালে নগর রাজনীতির এই মহানায়ক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল তৈরি করে প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। সে সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্রিন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসায়ও কোনো ফল হয়নি, বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় তা অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।
দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ। তার জীবদ্দশায় রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৬-এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। মাথায় বিদ্ধ স্প্রিন্টারের প্রতিক্রিয়া পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ও অকাল মৃত্যুর কারণ হিসেবে কাজ করেছে। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মোহাম্মদ হানিফ চলে গেছেন জাতির চরম দুঃসময়ে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ যখন সংকটাপন্ন, তখন জননেতা হানিফের মতো আদর্শনিষ্ঠ, অকুতোভয় ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের বড় বেশি প্রয়োজন। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়, দেশের রাজনীতিতে তার অবদান যুগে যুগে শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণীয়।