রাইসলাম॥ কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের কথা ছিল। তাই শুরু হয়েছিল নানা জল্পনা কল্পনা। বিভিন্ন মহলে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে আসছিল, তা হলো, হাসিনার এবারের সফরে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে কি? ক’দিন আগেও মোদী-মমতা লড়াই সত্ত্বেও তিস্তা চুক্তি রূপায়নে সরকার উদ্যোগী বলেই ভারতীয় সংসদে জানানো হয়েছিল। তাই শেখ হাসিনার ভারত সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, সেই সফর পিছিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘সফর এখনও চূড়ান্ত হয়নি, বরং সফর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে এ বিষয়ে আমরা কিছুই বলতে পারছি না। কোনো খবর নেই আমাদের কাছে। তবে সফর বাতিল হবার সম্ভাবনা কম। দিনক্ষণ এবং কর্মসূচি চূড়ান্ত হলে উভয়দেশ থেকেই তা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হবে।” পর্যবেক্ষক মহল অবশ্য প্রশ্ন করেছেন, কেন সফর পিছিয়ে দেওয়া হলো? এর কারণ কী হতে পারে? শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের কেন্দ্রবিন্দু তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বনাম প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংঘাত, বিশেষ করে নোট বাতিলের পর যেভাবে চরমে পৌঁছেছে, তাতে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস তিস্তা চুক্তি আটকাতে সাধ্যমত চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে মোদীর বিড়ম্বনা বাড়বে। সে জন্যই হয়ত দিল্লি ও ঢাকা শেখ হাসিনার সফরের তারিখ মাসখানেক পিছিয়ে দিয়ে পরিবেশ খানিকটা অনুকূলে আনতে চাইছে।
অথচ নোট বাতিলের ঘোষণার আগেও ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সঞ্জীব কুমার বালিয়ান সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, বংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নে মোদী সরকার আন্তরিকভাবে উদ্যোগী। জানিয়েছিলেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের গ্রহণযোগ্য এক সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব হবে। ঢাকার সঙ্গে এ বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল দিল্লি। বলা বাহুল্য, তিস্তা চুক্তির পথে সবথেকে বড় কাঁটা পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকার। শুরু থেকেই মমতার তৃণমূল সরকার এই চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছে রাজ্যের স্বার্থের দোহাই দিয়ে। ঢাকা সফরের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় অবশ্য অনেকটা নমনীয় অবস্থান নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমনিতে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক ভালো৷ তাই বলে রাজ্যের স্বার্থ বিলিয়ে দেওয়া যায় না।
অবশ্য অতি সম্প্রতি নোট বাতিলকে ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য তরজা এখন যে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা যায় কিনা বলা মুশকিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজ্য সরকারকে রাজি করাতে পারলে সেটাই হবে কাঙ্খিত। কিন্তু না পারলে সাংবিধানিক দিক থেকে কেন্দ্রের বাধ্যবাধকতা নেই, যেহেতু সংসদে মোদীর বিজেপি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তবে সেই রকম রাজনৈতিক ঝুঁকি মোদী নেবেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না।
অন্যদিকে সন্ত্রাস থেকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। সেটা নানাভাবে বুঝিয়েও দিয়েছে উভয় দেশের সরকার। সে কারণে হাসিনার ভারত সফরের একটা অন্য তাৎপর্যও থেকে যাচ্ছে। সন্ত্রাস প্রশ্নে দিল্লি যেভাবে ঢাকাকে পাশে পেয়েছে, তা প্রশ্নাতীত। পাঠানকোট, উরি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ইসলামাবাদের সার্ক সম্মেলন বয়কট করেছিল ঢাকা। সমর্থন জানিয়েছিল জঙ্গি মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। তাই ভবিষ্যতেও কৌশলগত কারণে হাসিনা সরকারকে পাশে পাওয়া প্রয়োজন মোদী সরকারের। তাই তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়নে দিল্লি যে কোমর বেধেঁছে, সেই বার্তাই দিতে চাইছিল মোদী সরকার।
সফর পিছিয়ে গেলেও, কথা হচ্ছে, রাজ্যে মমতা সরকারের সঙ্গে মোদী সরকারের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে কতটা আশা রাখতে পারেন? সরকারিভাবে সিলমোহর দেবার আগে বাংলাদেশ চাইতে পারে, পানির ভাগ-বাঁটোয়ারায় কোন দেশ কতটা পাবে, কতদিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হবে তার একটা সময় সীমা বেঁধে দেবার বিষয়ে আলোচনা চলুক। আলোচনা হতে পারে আধিকারিক স্তরে কিংবা যৌথ নদী কমিশন স্তরে, যেমনটা হয়েছিল স্থলসীমা চুক্তি সম্পাদনে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতার সঙ্গে চলতে পারে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। কিছুদিন আগেই ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারীকর। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তিনি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে। কথা বলেন বংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা জরুরি বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, নেপালের মতো ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর যেভাবে চীনের প্রভাব বাড়ছে, তাতে দিল্লির কপালে ভাঁজ পড়েছে। অন্যদিকে, শেষ পর্যন্ত মোদী সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হলে তাতে উঠে আসতে পারে অন্য সব দ্বিপাক্ষিক বিষয়। যেমন সীমান্ত এলাকায় জঙ্গিদের গতিবিধি সম্পর্কে দু’দেশের গোয়েন্দাদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান এবং সুন্দরবন জলসীমার নিরাপত্তা রক্ষায় যৌথ নজরদারি। উঠে আসতে পারে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ, মাদক, গবাদি পশু ও নারী পাচার ইত্যাদির মতো ইস্যুগুলিও।