মায়ের ভাষায় কথা বলার মজাটাই আলাদা। আর এই আলাদা মজাটা বোঝার সহজতম উপায়টি হল ভিনদেশী কারো সঙ্গে কথা বলা এবং ভিনদেশী ভাষায় কথা বলে কোনমতে জীবন পরিচালনা করার মাধ্যমে। বিশেষ করে প্রভাসী ভাই-বোনেরা হর-হামেশাই এই মার্তৃভাষার মর্ম উপলব্দি করছেন। কোরআনে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন আমি প্রত্যেক জাতির স্ব-ভাষায় নবী প্রেরণ করেছি যাতে নিজ নিজ ভাষায় আমার কালাম তোমাদেরকে বুঝাতে পারে। সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবীর মানুষের ভাষা ছিল এক ও অভিন্ন। আর তখন মানুষ বিশাল আকৃতির টাওয়ার বানিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছতে চেয়েছিল। তখন মাবুদ আল্লাহ তাদের ভাষার মধ্যে গন্ডগোল বাধিয়ে দিলেন এবং বহু ভাষা-ভাসি ও বহু জাতিতে পরিণত করলেন। সেই থেকেই এই ভাষার গুরুত্ব এবং মর্যাদা আজ অব্দি অক্ষুন্ন রয়েছে। এই বহু ভাষার মাধ্যমে আল্লাহর মহৎ পরিকল্পনা রয়েছে এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
বাঙালী বীরের জাতি আর এই বিরত্ব প্রমান করেছিল সেই ১৯৫২, ৬৯, ৭১ এবং বর্তমানে অপসংস্কৃতি ও অন্ধকারের কীট এবং এদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন করে। সেই সময় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রমান করেছিল সালাম, বরকত, রফিকসহ আরো হাজারো বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। দেশ এবং মায়ের ভাষাকে তারা কতনা ভালবেসেছিল যা আজোও আমাদেরকে আগামীর পথ চলতে অনুপ্রেরণা যোগায়। উৎসাহ যোগায় আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু দৃষ্টান্ত রেখে যেতে, যাতে তারা আমাদেরকেও স্মরণ করতে পারে তাদের জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে। শৈশব, কৌশর ও যৌবন পেরিয়ে যখন পৌড়ে উপনিত হয় তখনও শ্রুতিমধুর ভাষার কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয় না। এমনকি মৃত্যুর মুহুর্তেও এই মধুর ভাষা-ই আওড়িয়ে যায়। এই ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করে আমাদের কোন পরিচয়ই হয়ে উঠে না। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমি বাঙালী, বাংলা আমার মায়ের ভাষা। এই ভাষার জন্য লড়তে হয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে এমনকি অধিকার ছিনিয়ে আনতে হয়েছে… যা আজ সকলে স্বাচ্ছন্দে উপভোগ এবং চর্চা করে যাচ্ছি। পৃথিবীতে একমাত্র এই আমাদেরই মায়ের ভাষা এবং এর স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল আর আমরা সেই সংগ্রামে জয়ী হয়ে প্রমান করেছি বীর বাঙালী অধিকার আদায়ে দীপ্ত বলীয়ান এবং মাথা নোয়াবার নয়। পাকিস্তানী জেলে মৃত্যুর প্রহর গুণা মানুষটি যে কিনা আমাদের অস্তিত্বে বহমান সেই বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলেছিলেন আমি বাঙ্গালী, আমার রক্ত বেঈমানী করে না এবং আমার দামাল ছেলেরা দেশ মার্তৃকার তরে লড়বে; নিশ্চিত জয়ী হবে। মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার সোনার বাংলায় পৌঁছে দিও।
১০ আগষ্ট ১৯৭২ এ আমার জন্ম এবং সেই থেকে এই পর্যন্ত ভাষার ব্যবহার এবং ভাষা কেন্দ্রীক উদযাপন দেখেছি, করেছি। কিন্তু শৈশবের সেই স্বতস্ফুর্ততা যেন কোথাও খেই হারিয়ে ফেলেছি। এখন এই ভাষার মাসে আগের মতো আর সেই অমলিন আনন্দ, উৎসাহ এমনকি হৃদয়ের স্বতস্ফুর্ত দায়-দেনা পরিশোধের স্পৃহা দেখতে পাইনি। কেমন যেন লোক দেখানো দায়সাড়া ভাব চলে এসেছে। খুব দুঃখ ও কষ্ট অনুভব করি শৈশবের ফেব্রুয়ারি উদযাপন এবং বর্তমান ফেব্রুয়ারি উদযাপনের তফাৎ দেখে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে আরো গতিশীল এবং হারানো স্মৃতি, ঐতিহ্য ও ভাব গাম্বিয্য এমনকি ভাষার মাসের তাৎপর্য বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার কথা কিন্তু সেখানেই ঘটছে বিপত্তি। প্রযুক্তির যুগে হচ্ছে উল্টো আচরণ। যেই শুদ্ধ এবং প্রাণোচ্ছল ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল, নির্যাতিত হয়েছিল বাংলার মানুষজন। আজ কিনা সেই ভাষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে আমাদের এ যুগের শিক্ষিত মডারেট প্রজন্ম। বিভিন্ন রেডিও প্রতিনিয়ত ভাষার বিকৃতি করেই খান্ত হয়নি বরং জারজ ভাষা জন্মদিয়ে নতুন প্রজন্মকে তাঁর শিকর, ঐতিহ্য ও ইতিহাস বঞ্চিত করে যাচ্ছে। এখনই সময় ভাষা বিকৃতকারীদের চিহ্নিত করে ঐসকল রেডিওর লাইসেন্স বাতিলসহ উপযুক্ত শাস্তির বিধান করা। ভাষার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আমাদের আঞ্চলিকতা এবং এই আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের বাংলা, বাঙালী এবং মার্তৃভুমি বাংলাদেশকে বহু রূপ লাবন্যে রসাত্ববোধক ছন্দে আবৃত করে রেখেছে যা দর্শনীয়, মোহনীয় এবং বাঙ্গালীর গর্ব ও অহংকারতুল্য। সেই অহংকারেও এখন ছেদ ঘটিয়ে যাচ্ছে অহরহ। প্রযুক্তির কল্যাণে এইসকল হরহামেশাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে যাচ্ছে তাই বিনীত অনুরোধ এখনই একটা কিছু করুন। নতুবা হারিয়ে যাবে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আত্মত্যাগের ফসল।
ফেব্রুয়ারী মাসের গুরুত্ব যেন ২১শে ফেব্রুয়ারীর মাধ্যমে শেষ না হয়। এই চেতনা যেন জাগ্রত হয় পুরো বছরের জন্য এবং এই চেতনায় বলিয়ান হয়ে আগামী প্রজন্মকে আরো যুগোপযোগী করে তুলতে অনুপ্রেরণা যুগানোর এখনই সময়। আসুন বাংলা একাডেমির উদ্যোগের সঙ্গে সাড়া দেশবাসীর যোগসূত্র গড়ে তুলি। এই বইমেলাকে রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীক না রেখে জেলা কেন্দ্রীক বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস চালানোর এখনই উপযুক্ত সময়। যাতে সকল জেলায় এই মেলার আয়োজন করে মানুষকে জানতে, বুঝতে এবং জ্ঞানের সঙ্গে বসবাস করতে সহযোগীতা করুন। এইতো জ্ঞানের অভাবে ঘটে গেল এক জঘন্য কাজ যা মিডিয়ায় এখন তোলপাড় চললে। শিক্ষার্থীদের পিঠে চড়ে দাতার বাহাদুরী। কি ঘটছে ঐসকল এলাকায়। সেখানে কি কোন শিক্ষীত এবং জ্ঞান বিলানোর কারিঘর নেই? তারাকি পারেনি ঐসকল অমানুষদেরকে মানুষে পরিণত করতে। শৈশবে তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে শিখেছিলাম মষ্টর থেকে হয় ছত্র আর মাষ্টার থেকে হয় ছাত্র। মানুষ আর মনুষ এর তফাৎ এবং মান+ হুস এর বিস্তারিত বর্ণনা। ঐ ধরনের শিক্ষক বা মাষ্টার সাহেবের উদয় কবে হবে আমাদের এই সোনার বাংলায়? আমার বিশ্বাস এইসকল ঘটনার পিছনেও রয়েছে কোন ভাল উদ্দেশ্য। ইতিবাচক এই উদ্দেশ্যই যেন আমাদের আগামীর পথ চলাতে পাথেয় হয়ে থাকে। শিক্ষা সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে যেন প্রকৃত শিক্ষার তাৎপর্য এবং প্রকৃত শিক্ষায় অর্জিত দৃষ্টান্তগুলো প্রকাশিত হয়ে সমাজে আগ্রহ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়।
পরীক্ষায় শুধু সার্টিফিকেট লাভের আসায় পরীক্ষা না দিয়ে বড়ং জ্ঞানের পরিমাপক হিসাবে দেখার সুযোগ নিয়ে এর প্রসারতাকে বাড়িয়ে তুলতে চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু জ্ঞান মাপার কোন যুন্ত্র এখনও আবিস্কার হয়নি তথাপি বলতে পারি বিভিন্ন পরিক্ষার মাধ্যমে নুন্যতম হলেও এর পরিমাপ করা যায় এবং দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে সঠিক জ্ঞানের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ হয়। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। এটা একটা বিশাল পাওয়া এবং আগামীতে এই বাংলাদেশই বিশ্বে জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রথম স্থান দখল করে থাকবে। শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের প্রশাসন এখন অনেক যুগোপযোগী হয়েছে। এইতো লুন্ঠিত মাল থেকে নাশকতাকারী এবং আগুন সন্ত্রাসী ও গুপ্তহত্যাকারীদের সমুলে বিনাশ করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং নতুন নতুন যে পরিকল্পনা বা ছকই কসছে সেই সবই ধ্বংস করতে তৎপর এবং প্রারঙ্গন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো।
জ্ঞানের পরিধির সম্প্রসারণ ও যুগোপযোগী বা হালনাগাদ হওয়ার দারপ্রান্তে এখন বিডার কার্যক্রম। সহজ ও ব্যবসা বান্ধব নীতি নিয়ে এগুচ্ছে বিডা (বাংলাদেশ ইনভেষ্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি)। আইন মন্ত্রণালয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তাদের পথ চলায়। ভাষার মাসে বলতে চাই যারা এখনও বাংলা ভাষা বুঝতে এবং এই ভাষায় চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন নাই আপনারা কিন্তু সেই ৫২’র ভাষাবিরোধী শিবিরের অনুসারী। আর তাই যদি হন তাহলে দয়া করে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করুন। যাতে জাতি আপনাদেরকে চিনতে ও বুঝতে এবং জানতে পারে। আপনাদের পরিকল্পনা এবং চিন্তা চেতনায় এখন আমুল পরিবর্তন আনা দরকার। কারণ যুগের প্রয়োজনে সময়ের বিবর্তনে আপনাদের সেই ঘুনেধরা স্বভাব এখন আর কাজে লাগবে না। খুলস না পাল্টিয়ে বরং মনে প্রাণে পরিবর্তন হয়ে আগে একজন বাঙালী হউন তারপর এগিয়ে আসুন ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেশ মার্তৃকার তরে কল্যাণের লক্ষ্যে। জনগণ আপনাকে দেখছে এবং অনুসরণও করছে। আপনি যা দেখছেন না বা বুঝতে পারছেন না তা কিন্তু জনতা দেখছে এবং বুঝছে। সুতরাং সাবধান আচরণে, কথাবার্তায়, চাল-চলনে এমনকি রাজনৈতিক আদর্শে। জনগণের ছোয়া বা সমর্থন এখন আর ফাকা কথায় নয় বরং কাজে পরিচয়ের মধ্যে নিহিত। তাই আগামীর কথা, কাজ, ভাষাগত জ্ঞান এবং চর্চা সবকিছুই যেন হয় সার্বজনীন এবং যুগোপযোগী। তাহলেই সফলতা আসবে। জোর করে ক্ষমতা বা সম্মানের স্থানে যাওয়ার আর সময় এখন নয় বরং জনগণের মনোভাবের প্রতিফলই আপনাকে নিয়ে যেতে পারে আগামীর সেবকের ভুমিকায়। জনগণকে লক্ষীতুল্য ভেবে কাজ করুন। স্বার্থের দন্ধ এবং অর্থের লিপ্সা থেকে বের হয়ে আসুন। এই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীর শিক্ষা ও চেতনায় নিজেদেরকে সাজিয়ে তুলুন তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।