ঝিনাইদহ প্রতিনিধি॥ সাবেক পুলিশ সুপার ও নিহত মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারের মাগুরার বাড়িতে উঠেছেন তার কথিত প্রেমিকা বনানী বিনতে বছির বর্ণি। তিন মাস ধরেই তিনি বাবুলের মাগুরার বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন। তার স্বামী স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসআই আকরাম ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে কথিত ‘সড়ক দুর্ঘটনা’য় নিহত হন। যদিও এটিকে হত্যাকান্ড উল্লেখ করে বাবুল এবং বর্ণিকে আসামি করে মামলা করেছিলেন আকরামের বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি। নিহত আকরাম হোসেন তখন বিমানবন্দরে স্পেশাল ব্রাঞ্চে এসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আকরামের পরিবারের অভিযোগ, বাবুল আক্তার প্রভাব খাটিয়ে ওই মামলার তদন্ত করতে দেননি। এটিকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাল্টে দিয়েছে। ঝিনাইদহের তৎকালীন এসপি আনিসুর রহমান এসআই আকরামের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগে কর্ণপাত না করে দুর্ব্যবহার করেই বিদায় করে দেন। এই অভিযোগ করেছেন নিহত এস আই আকরামের বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি। তিনি বলেন, ঢাকার মগবাজারের নয়াটোলা প্রাইড ভবনের ৬ তলায় তার ভাইয়ের কেনা ফ্ল্যাটটিতে তালা দিয়ে প্রায় তিন মাস আগে বর্ণি মাগুরায় চলে যান। তিনি রবি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেখানে তার মেয়ে আফরিনকে নিয়ে বাবুল আক্তারের বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন।
এসব তথ্য তিনি বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেনকেও জানিয়েছেন। জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি ভাই হত্যার বিচার চেয়েছেন। আমিও চাই মিতু হত্যার তদন্তের সঙ্গে আকরামের হত্যারও তদন্ত করা হোক। তাহলে আসল ঘটনা সবাই জানতে পারবে। এতে নিহত আকরামের পরিবারও ন্যায়বিচার পাবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নিহত এসআই আকরামের স্ত্রী বর্ণি মাগুরায় বাবুল আক্তারের বাড়িতে বসবাস করছেন বলে তিনিও শুনেছেন। তবে ক্ষোভে-দুঃখে তিনি বাবুল আক্তারের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।’এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন জানান, এতদিন তারা বাবুলের পরকীয়ার কথা শুনলেও কার সঙ্গে জানতেন না। এখন তারা বুঝতে পারছেন আসলে বাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কার।
এ ব্যাপারে জানতে বাবুল আক্তারের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। আকরামের স্ত্রী বর্নির বাবা বশির উদ্দিন বাদশা বলেন, ‘আমি বাবুল আক্তার নামে কাউকে চিনি না। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ও নেই। তবে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পত্রিকায় তার ছবি দেখেছি। তখন থেকে তার নাম জানি।’ মেয়ের সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো বাজে কথা। ’আপনার মেয়ে বর্ণি এখন কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তার ফোন নম্বর চাইলে বলেন, ‘আমার মেয়ের ফোন নম্বর আপনাকে দেব কেন?
বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মোবাইল নম্বরটি প্রয়োজন এমন কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্যই তার (বর্ণি) বক্তব্য। ’সূত্র জানায়, পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে পুলিশের এক এসআইকে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করানোর অভিযোগ উঠেছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে। দু’বছর আগের এই হত্যাকান্ডকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নিজ বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার পরও তৎকালীন ঝিনাইদহের পুলিশ এ ব্যাপারে এসআই আকরামের পরিবারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। তারপরও আকরাম হোসেনের বোন বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলাটির তদন্ত একচুলও এগোয়নি। বিচারের আশায় আকরামের ছোট বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি বাবুল আক্তারের শ্বশুরের সঙ্গে সম্প্রতি দেখা করেছেন। নিহত আকরাম হোসেন ওই বিমানবন্দরে স্পেশাল ব্রাঞ্চে এসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
নিহত আকরাম হোসেনের বোন রিনি বলেন, ‘২০০৫ সালের ১৩ জানুয়ারি তার ভাই এসআই আকরামের সঙ্গে বর্নির বিয়ে হয়। সাতক্ষীরায় বাবুল আক্তারের বাবা ও বর্নির বাবা পাশাপাশি বাসায় থাকতেন। বর্নির বাবা বিআরডিবিতে চাকরি করতেন। আর বাবুলের বাবা পুলিশে। সেই সুবাদে তাদের দু’জনের মধ্যে পারিবারিক ভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়। তখন থেকেই বাবুল আক্তারের সঙ্গে বর্নির সম্পর্ক হয়। এর মধ্যে পরিবারের সিদ্ধান্তে মিতুকে বিয়ে করে বাবুল। আর বর্নির বিয়ে হয় আকরামের সঙ্গে। কিন্তু বাবুল আর বর্নির মধ্যে তখনও যোগাযোগ ছিল। প্রথমে আমরা বিষয়টা বুঝতে পারিনি। পরে বিষয়টা ধরা পড়ে। রিনি বলেন, আমাদের পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই ছিল আকরাম।
বিয়ের ঠিক ১০ বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় মহাসড়কে মাথায় কুপিয়ে ভাইকে আহত করা হয়। ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান। তখন পুলিশ ঘটনাটিকে ট্রাক চাপায় সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করে। রিনি বলেন, ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর আকরামকে ডেকে নেয় বর্ণি। ওই সময় বর্ণি বলে তুমি যমুনা সেতু হয়ে আসো। আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় চলে যাব। পথে তারা গুন্ডা ফিট করে রাখে। আমার ভাই সকালে বাসা থেকে বের হয়। পথে গুন্ডা দিয়ে সারাদিন তাকে পথে আটকে রাখে। রাত ১১টার দিকে তাকে মেরে রক্তাক্ত অবস্থায় ঝিনাইদের শৈলকুপা থানার বরদানগ গ্রামে রাস্তার ওপর ফেলে রাখে।
রিনির দাবি চিকিৎসকরা তখন তাদের জানিয়েছিলেন, আকরামের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তখনই আমরা সন্দেহ করি এটি হত্যা। কিন্তু ওই ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। আমরা ওই মামলায় বাবুল আক্তার, তার ফুপাতো ভাই সাদিমুল ইসলাম মুন ও নিহত আকরামের স্ত্রী বনানী বিনতে বছির বর্ণিকে আসামি করি। কিন্তু পুলিশ তাদের নাম বাদ দিয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে একটি মামলা রেকর্ড করলেও তদন্ত আর এগোয়নি। তখন বহু মানুষের কাছে বিচার চেয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। রিনি আরও জানান, ছেলের শোকে এসআই আকরামের স্কুল শিক্ষক বাবা মো. আবুল হোসেন প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। মা ছেলের মৃত্যুর মাত্র ৮ দিন আগে ৫ জানুয়ারি তার মা আলেয়া বেগম মারা যান।
রিনি অভিযোগ করেন, একসময় এ নিয়ে আমার ভাইয়ের স্ত্রী বর্ণির সঙ্গে বাবুল আক্তারের পরকীয়া সম্পের্কের অবনতি হয়। এক পর্যায়ে আমার ভাই তার স্ত্রীকে ঝিনাইদহে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এ নিয়ে মীমাংসার কথা বলে ঝিনাইদহে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাড়িও ঝিনাইদহ সদরে। তারপরও পুলিশ তখন আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি। যদি এটি দুর্ঘটনাই হয়, তাহলেও তো অভিযুক্ত ট্রাক চালককে আটক করবে, ট্রাকটি জব্দ করবে। কিন্তু তারা এসবের কিছুই করেনি। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের মগবাজারে একটি ফ্ল্যাট ছিল। সেই ফ্ল্যাটে এখন বর্ণি বসবাস করে।
বাবুল আক্তার বর্তমানে আদ-দ্বীন হাসপাতালে চাকরি নিয়েছেন। ওই ফ্ল্যাটটি হাসপাতালের পাশেই। বাবুল আক্তারও বর্তমানে আদ-দ্বীন হাসপাতালের নিজস্ব একটি ফ্ল্যাটে ওই এলাকাতেই থাকেন। এখনও তাদের দু’জনের মধ্যে খুবই সখ্য আছে বলে আমরা শুনেছি। রিনি জানান, বাবুল তখন এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগই শুনতে চাইত না। অভিযোগ করতে গেলে ঝিনাইদহের তৎকালীন পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান অনেক দিন তাদের গালিগালাজ করেন। মূলত বাবুলের প্রভাবের কারণেই আমাদের পরিবার ন্যায়বিচার পায়নি। আমার বিশ্বাস, এখন সঠিক তদন্ত হলে ন্যায়বিচার পাব। রিনির দাবি, তার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে, অথচ তারা বিচার পাননি। এসব বিষয়ে বাবুল আক্তারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মদনপুরে বাবুল আকতারের পৈত্রিক বাড়ি। সেই বাড়িতে এখন আর পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবুলের বাবা আবদুল ওয়াদুদ মাগুরা শহরের কাউন্সিল পাড়ায় পরে যে বাড়ি করেছেন সেখানেই পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। গত বছরের ৫ জুন চট্রগ্রামে নিহত হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। মোটর সাইকেলে করে আসা তিন দুর্বৃত্ত মাহমুদা খানম মিতুকে প্রথমে ছুরিকাঘাত ও পরে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। সেদিন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে চট্রগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ের দিকে যাওয়ার পর এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি আগে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্ত্রীর হত্যাকান্ডের আগে এসপি পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে আসেন।
ওই দম্পতির সাত বছর বয়সী এক ছেলে ও চার বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। এরপর ২৪ জুন দিবাগত রাতে রাজধানীর বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁর শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান। পরদিন স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বাবুল আক্তারকে তাঁর স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এর পর থেকেই কার্যালয়ে নিয়মিত ছিলেন না বাবুল আক্তার। এরপর খবর বের হয় বাবুল আক্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে এটি কখনো স্বীকার করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক।
নানা নাটকীয়তার পর গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে ওই দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রঙ্গাপন জারি করে। গত ২২ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেনকে মিতু হত্যা মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারও সিএমপিতে এসে তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।