জ্যাকব থমাস॥ সালাম সালাম হাজার সালাম, সালাম শহীদ স্মারণে, আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই, তাদের স্মৃতি চরণে…..
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে… স্বাধীন আশায় পথ চলাতে—- হাসি মুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ— সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যায় গান।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি; ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এই ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?
দুনিয়ায় বাংগালিদের মত আর কোন জাতি মার্তৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে নি। এইজন্য আমরা প্রত্যেক বছর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের কথা স্মরণ করি, শহীদ মিনারে পুস্পার্ঘ অর্পন করি। তবে শুধু তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনেই যেন সব শেষ না হয়- এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে। মার্তৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। তাই আসুন আমরা এই একটু চিন্তা করি।
ভাষার প্রতি আমরাও যেন দেখাই আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা; সম্ভব হলে এই ভাষার উৎকর্ষে আমরাও যেন কাজ করি।
মার্তৃভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয় কী?ঃ বিদেশী ভাষা পুরাপুরি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। একজন বিদেশী ভাষার ছাত্র যতই আগ্রহ থাকুক ও কঠোর পরিশ্রম করুক না কেন, তার উচ্চারণ এবং ব্যাকরণের জ্ঞান সবসময় একজন দেশীয় নিরক্ষর কৃষকের চেয়ে দুর্বল থাকবে। প্রত্যেক সমাজে মানুষের ভাষার ব্যবহারে তার বুদ্ধি যাচাই করা হয়। এইজন্যে, একজন বিদেশী বক্তার পক্ষে দেশী বক্তার সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠা প্রায় অসম্ভব, কারণ তিনি তার স্বল্প ভাষাজ্ঞানের কারণে যুক্তি প্রকাশে অসমর্থ। যেমন, পাকিস্তান আমলে কোন বাঙালী একজন পাকিস্তানীর সঙ্গে উর্দু ভাষায় বিতর্কে জিততে পারত না।
বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়ার প্রয়োজন কি ছিল? ইতহাসে আমরা শিখি যে সা¤্রাজ্যবাদের একটি প্রধান কৌশল হচ্ছে অন্য দেশে তাদের নিজ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা। এইভাবে তারা সেই জাতিকে সহজে দমনে রাখতে পারে, কারণ ঐ জাতির নেতারা যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, তারা কখনও সমানভাবে সা¤্রাজ্যবাদী জাতির লোকদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে পারবে না এবং সবসময় তাদের ঠকানো যাবে। সেই দমনে – রাখা দেশের লোক সবসময় চিন্তা করবে যে, বড় বা প্রভাবশালী হতে হলে সেই সা¤্রাজ্যবাদীদের ভাষা ভালভাবে শিখতে হবে। এইভাবে সমাজের বড় নেতারা সমসময় সেই বিদেশী ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন যা কখনই তাদের পক্ষে পুরাপুরি আয়ত্ত করা সম্ভব ছিল না। এই ব্যর্থতার ফলে তাদের সবসময় সমাজের নিচু স্তরে থাকতে হয়েছে। যেমন ধরুন ইংরেজ কোম্পানী তাদের শাসনকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিজের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এইজন্য ভারতবর্ষের নেতাদের ইংরেজি ভাষা ও নিয়ম শিখতে হয়েছে। পাকিস্তানী নেতারা যখন আমাদের পিতৃপুুষদের উপর এইভাবে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করল, তখন তারা প্রচন্ড বাধার সম্মুখে সংগ্রাম করেছিল, কারণ উর্দূ রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালি জাতি সবসময় উর্দূভাষীদের নিচে থাকত। এইজন্য আমাদের জাতির হাজার হাজার মানুষ মার্তৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন।
ধর্মের ক্ষেত্রে মার্তৃভাষা: এখানে দেখা যায় যে, এক জাতি অন্য জাতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি অপর জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়। অন্য জাতিকে নিয়ন্ত্রণের এই কৌশল প্রায় সকলে জানে, কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রেও যে এটা ঘটে সেটা খুব কম লোকই লক্ষ করে।
ইতিহাসে দেখা যায় প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় পেশাদার গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকে আন্তরিকভাবে আল্লাহর পথে মানুষকে পরিচালনার শিক্ষা দেয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, এমন ধর্মীয় নেতারা ঐশী তথ্য শিক্ষা না দিয়ে বেশি চিন্তা করে কিভাবে তারা তাদের নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করবে।
ধর্মীয় জ্ঞান নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে, ধর্মীয় পেশাদাররা তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের চাহিদা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এছাড়াও তারা দেখাতে চান যে, এদের ধর্মীয় পদ্ধতি অন্যান্য সব ধর্মীয় পদ্ধতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এটা না করলে, মানুষ হয়ত এদেরকে ছেড়ে অন্য ধর্মীয় পথে যাবে। এইভাবে দেখা যায় যে নিজের ধর্মীয় পদ্ধতির দুর্বলতা অস্বীকার করা বা ঢেকে রাখার একটি বর প্রবণতা আছে।
একটি উদাহরণ- দু’হাজার বছর আগে রোম সা¤্রাজ্যের অনেকে ইহুদী-ধর্মের একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হল। অনেক অ-ইহুদী লোক ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু সেকালের ইহুদী সমাজ গর্ব করে ভাবত যে তাদের তৌরাত শরীফ যেহেতু তাদের নিজের হিব্রু ভাষায় নাজেল হয়েছিল তাই সেই ভাষা একটি স্বর্গীয় বা ঐশী ভাষা (লেশন হা-কোদেশ)। এজন্য তারা অ-ইহুদী হানাফীদের তাদের যার যার মাতৃভাষায় প্রার্থনা না করে যে ভাষা তারা বুঝতো না সেই হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা করতে বলল। এটি আল্লাহর আদেশের বিপরীতে হল, কারণ অল্লাহ ইহুদী জাতিকে পৃথিবীর কাছে তাঁর সংবাদ পৌঁছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ইহুদী বা ই¯্রায়েলীয়রা আল্লাহ প্রদত্ত সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার আংশিক কারণ হচ্ছে যে, তারা মনে করতো যে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি অন্য জাতির চেয়ে উন্নত।
তেমনিভাবে, চীনের বৌদ্ধ ও কনফুশীয় ধর্মে চীনের জটিল লেখার পদ্ধতি একটি স্বর্গীয় ভাষার মত ধারনা করা হত, জনগণের কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা দূরে রাখার জন্য। এই চল্লিশ হাজার অক্ষরের লেখার পদ্ধতি শিখতে জনসাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকত, কারণ অক্ষর-পরিচয় শিখতে ৩-৪ হাজার অক্ষরের মুখস্থ করা লাগে। কোরিয়ান ‘হাঙ্গুল’ বর্ণমালার মত আর কোন সহজ বর্ণমালা ছিল, কিন্তু কনফুশীয় ধর্মযাজকরা তা নিসেধ করে বলত যে, ধর্মে শুধু সেই কঠিন বর্ণমালা ব্যবহার করা চলবে।
শত শত বছর আগে আর্য ব্রাহ্মণরা যখন বঙ্গে সিন্ধু এলাকা থেকে এসেছিল, তখন তারা স্থানীয় দ্রাবিড়দের বলত যে, আর্য ভাষা, অর্থাৎ সংস্কৃত হচ্ছে ঐশী ভাষা এবং তাদের বাংলা ভাষাটি ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহারে অযোগ্য। এইভাবে সেই আর্য-ব্রাহ্মণ শ্রেণী শত শত বছর ধরে তাদের নিজের স্বার্থে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ধর্মশাস্ত্র পড়া এবং প্রার্থনা করা যায় শুধু সংস্কৃতে; তার মানে ঈশ্বর শুধু সংস্কৃত গ্রহণ করে, বাংলা নয়। চলমান… আগামি সংখ্যায়।