রাজুল ইসলাম॥ বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৩ সালে অনেকেই মনে করেছিলো বিরোধী দল থেকে সরকারী দলে পরিণত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র কয়েক মাস পরের সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল। কিন্তু ‘সেই’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি এবং যার ফলে ওলটপালট হয়ে যায় বিএনপির সব হিসাব নিকাশ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মামলার বেড়াজালে আটকে দেয়। জনগণের ভোট চলে যায় নির্বাসনে, বিধ্বন্ত হয়ে যায় বিএনপি। এরই মধ্যে মামলার বেড়াজালে পড়েছে বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতা। জিয়া অরফানেজ এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কয়েক মাসের মধ্যেই রায় হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনও হতে পারে এ রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হতে পারে।
কারাগারে যেতে হলে তাকে ‘সাময়িক’ রাজনীতি থেকেও দূরে থাকতে হতে পারে। সরকারও চাচ্ছে এমনটিই। খালেদা জিয়া নির্ভর দলটির দশা তখন কী হবে এমন ভাবনাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। অবাক করার বিষয় যে এত বিশাল জনপ্রিয়তা থাকার সময়ে প্রতিষ্ঠার ৩৮ বছর পর দলটি এখন অস্বাভাবিক অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না। কারণ দলটি এখন দীর্ঘতম সময় সরকারের বাইরে থাকার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দুরাবস্থায় রয়েছে। আর রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা ও সুবিধা কেন্দ্রীক। দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে দলটি এখন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে পারছে না। দলীয় সভা-সমাবেশেও তেমন উপস্থিতি নেই নেতাকর্মীদের।
বিএনপির জন্য এমন পরিস্থিতি এমন যে রাজনীতি করতে হলে হয় জীবন হাতে নিয়ে রাজপথে আসো, জেল খাটো, ঘর ছাড়ো আর না হয় রাজনীতিটাই ছেড়ে দাও। সরকারও সে পথেই এগুচ্ছে। এ অবস্থা আর কতদিন! ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মাঠের নেতাকর্মীরা।
বিএনপি এখন যে বিপর্যয়ে পড়েছে তা কি এড়ানো যেত না? এটা নিশ্চিত ছিল যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি অংশ গ্রহণ করতো এবং আজকের এ পরিণতি ভোগ করতে হতো না। বিগত সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনই তার প্রমাণ। কিন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না থাকায় বিএনপি অনিবার্য আশঙ্কা থেকে সে নির্বাচন বয়কট করে। নেমে পড়ে নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে। সে আন্দোলনের কারণেই ১৫৩ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। বাকি আসনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি সেদিনের মিডিয়ায় হাসি তামাশার খোরাক হয়েছিল। এরপরও যদি বলা হয় যে বিএনপি ভোট ঠেকাতে পারেনি তাহলে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে জনগণের সাথে সম্পর্কহীন হিসাবেই বিবেচনা করতে হয়। যে পরিকল্পনায় ম্যান্ডেটকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে ধরা হয়েছিল সে পরিকল্পনার প্রাথমিক বাস্তবায়নে বিএনপির এ পরিণতি অনিবার্য ছিল।
বিএনপির শক্তির প্রধান উৎস বিশাল ভোট ব্যাংক। সেই ভোট ব্যাংকের উপর ভর করেই বিএনপি সরকারে ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই জনগণকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে দশম সংসদ নির্বাচনে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। আগামীতে সবগুলো আসনে ভোট না হলেও সরকার গঠনে আইনগত সমস্যা হবে না এমনটিই অনুমেয়। কেননা, জোর যার মুল্লুক তার- এমন নীতেই এখন দেশ চলছে।
আবার যে নির্বাচনে জনগণের ভোট জয় পরাজয়ে কোনো প্রভাব রাখবে না সেরুপ নির্বাচনে বিএনপির সুদিন ফিরবে না। অন্যদিকে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করাতে নির্বাচন ও সরকার গঠনেও কোনো সমস্যা হবে না। এভাবে যদি বিএনপিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রাখা যায় কিংবা জনমতের প্রতিফলন এড়ানো ভোট সম্ভব হয় তাহলে রাজনীতির সাথে সাথে দলটিও অদৃশ্যমান হয়ে যাবে। এমনটিই ভাবনায় রয়েছে ক্ষমতাসীনদের।
বিএনপির জন্য নতুন নির্বাচন কমিশন ছিল খুবই গুররু¡পূর্ণ। কিন্তু সে আশাও গুঁড়ে বালি। ফলে সবমিলেই বিএনপির দৈন্যতা যে সহজেই কাটছে না তা দৃশ্যমান।