১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:৫০ । আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৯:৫১
ফারদিন ফেরদৌস॥ আজ ভোরের সূর্যটা নতুন প্রাণৈশ্বর্য্য আর রক্তিম লালিমা নিয়ে তার মুখ তুলে ধরেছিল। পলাশ আর শিমুলে খেলা করছিল এক অবিনাশী আগুন। দয়িতার স্নিগ্ধ আঁখি প্রস্ফুটিত হয়েছিল খোলা দখিন দুয়ারে। আম্রমুকুলের মৌতাতে মেতেছিল সুধাপিয়াসী ভ্রমর। নতুন পাওয়া সবুজে সেজেছিল কচি পত্র-পল্লব। রংবেরঙের প্রজাপতিরা খুঁজছিল নবপুষ্পের সজ্জা। শীতনিদ্রা শেষে প্রাণ-প্রকৃতির জেগে ওঠার এমন গুঞ্জরণ আর অমৃত ঘ্রাণে অধীর আকুল হয়েছিল কি দয়িত’র মন? মানুষের মনে বেঁজেছিল বিচিত্র রাগ। মন কেমন করা অন্যরকম বিহ্বলতা প্রেমময়ীর হৃদয়ে? বিরহদহনটা কি পোড়াচ্ছিল রাবীন্দ্রিক সুরে- ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার! তবে তো বসন্ত এসে গেছে। … সহসা খুলিয়া গেল দ্বার …. আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি …. দাঁড়াল করিয়া নমস্কার!
তাই আনন্দ, উৎসব আর ভালোবাসায় মেতে ওঠুক সবার প্রাণ। বসস্ত বন্দনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে/ তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে। অথবা মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/ মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে/ কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে, লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরণ ছটাতে।
আর প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, বসন্ত মুখর আজি/ দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি। আজ ফাল্গুন, আজ বসন্ত। তাই উৎসবের রঙে মেতেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক, উত্তরার রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চসহ সারা দেশের আনাচ-কানাচ। এসব উৎসবমালায় থাকছে যন্ত্রসংগীত, বসন্তকথন পর্ব, প্রীতি বন্ধনী, আবির বিনিময়, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য এবং আদিবাসীদের ও শিশু-কিশোরদের বিশেষ পরিবেশনা। দেশের বরেণ্য শিল্পীবৃন্দসহ আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণ করছে।
আমাদের অবগুণ্ঠিত ও কুণ্ঠিত আটপৌরে জীবনে নতুন উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছে বসন্ত। আজ তাই জীবনের কোনোই বিড়ম্বনা নয়; ভালোবাসার সুর সাধনা আর মুখর কথামালায় আপনপর ভুলবার দিন। মুক্তবিহঙ্গ হয়ে অবারিত গগনে উড়বার দিন। যাকিছু শোকতাপ বিয়োগব্যথা সব পেছনে রেখে মধুর ঐকতানে মিলবার দিন। কবি নজরুলের মতো করে আপনারজনকে আহ্বান করবার সময় আজ এই তো-
আসিবে তুমি জানি প্রিয় —– আনন্দে বনে বসন্ত এলো —– ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।
সেই যে বালকটি পরিবারের সবার মুখে অন্ন জোগাতে লেখাপড়া লাটে উঠিয়ে লেদ মেশিন, ইটের ভাটা কিংবা পরিবহনে রোজকার কর্মনিষ্ঠায় ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম; তার জীবনে বসন্ত ছুঁয়ে যাক। গ্রামীণ ঘুটে কুড়ানি মা যার কন্যা টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়ে নেন ঢাকার নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবনেও ধরা দিক বসন্ত। প্রিয় বসন্ত রাঙিয়ে যাক শহুরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর প্রাণেও; যাঁর হস্তকর্ম ঢেকে দেয় নাগরিক নোংরা-আবর্জনা। সকল শিশুর নিরাপত্তা ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করবার সদিচ্ছা হোক আমাদের বসন্ত প্রয়াস।
আজ বসন্তে এই প্রতীতি যে, আমাদের রাজনীতির বাতাবরণ খুলে যাক সকল ত্যাগী মানুষের জন্য। বিনাশ ঘটুক অবৈধ অর্থলোলুপদের। গুমোট আবহাওয়া কেটে গিয়ে সংলাপ চলুক পক্ষে-প্রতিপক্ষে। অধিকার সমুন্নত থাকুক সবার। বিপদ, বাধা-বিপত্তি কেটে যাক। হিংসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ দূরীভূত হোক। প্রতিষ্ঠিত হোক চিরকল্যাণ আর অমীয় প্রেম। নির্যাতিত-নিষ্পেষিত যে মানুষটি বিনাবিচারে ঘুরে মরছে দেশময় এখানে সেখানে, আজকের এই প্রিয় বসন্তদেবী তাঁর কথাটাও মনোযোগ দিয়ে শুনুক। অভেদ মানুষের একটাই সংসারে জ্বলুক ফাল্গুনের দীপ্ত শিখা। সত্যনিষ্ঠার জয়গান আর মিথ্যা, অন্যায় ও অসাধুতার নিপাত কামনা হোক আমাদের সমস্বর বসন্ত বন্দনা। আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের চৈতন্যের সর্বাঙ্গে জেগে ওঠুক ফাল্গুন, জেগে ওঠুক বসন্ত।
শেষে শিল্পী অনুপম রায়ের আধুনিক বসন্ত বন্দনার সঙ্গে মিলে যাক সকল প্রেমিক মানুষের প্রাণান্ত সুর-
একরাশ বিপদের মাঝখানে শুয়ে আছি
কানাঘুষো শোনা যায় বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে কবিদের মৃতদেহ
চাপা পড়ে কাগজে বসন্ত এসে গেছে
তার ছেঁড়া যন্ত্রের মাঝখানে শুয়ে আছি আমলকী বনে শোনো…
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে!