জ্যাকব থমাস॥ চলমান… “ঐশীভাষা” চিন্তাধারার ফলাফল: এই সব ক্ষেত্রে মাতৃভাষার অস্বীকারের ফলাফল খুব ক্ষতিকর। এদিকে ঐশী ভাষা একটি ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ রাখার কৌশল হয় এক জাতি অন্য জাতির প্রতি। বিদেশী ধর্মীয় পেশাদাররা এবং তাদের দালালরা শক্তভাবে ধর্মের শিক্ষার অধিকার ধরে রাখে এবং সাধারণ মানুষের শাস্ত্র-অজ্ঞতা শোষণ করে বা সুযোগ নেয়। যেহেতু মানব-জাতির ক্ষমতা অপব্যবহার করার একটি প্রবণতা আছে, সেহেতু আমরা ইতিহাসে বারবার দেখি ‘ঐশীভাষা’র কারণে ধর্মের মাধ্যমে সত্যকে ঢেকে রাখা, যেমন ব্রাহ্ম্যবাদে আর্যরা যেভাবে দেশী “স্লেচ্ছ”-দের আয়ত্ত করেছেন। অপরঞ্চ, অনেক ধর্মীয় নেতারা তাদের ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন অরুচিকর অংশ ঢেকে রাখে। তাদের নিজের মর্যাদা বা প্রভাব যেসব অংশ অস্বীকার করে বা তাদের ধর্মীয়ধারার দুর্বলতা প্রকাশ করে এমন ধর্মীয়গ্রন্থের অংশ তারা ঐশীভাষার মাধ্যমে জনগণের কাছে ঢেকে রাখে এবং অস্বীকার করে।
ইতোমধ্যে, সাধারণ মানুষ ধর্মীয়গ্রন্থের সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং কিতাবের মূলশিক্ষাগুলো না বুঝে অবুঝ বাহ্যিক সম্মান দেখায়। এই ধরণের ঐশীভাষা চিন্তা বিশ্বজগতে যেখানেই থাকে সেখানে জনগণ মনে করে যে ধর্মীয়গ্রন্থের মূল ব্যবহার হচ্ছে যাদু হিসাবে, মন্ত্র হিসাবে, তাবিজ হিসাবে এবং সঠিক উচ্চারণে পড়ে সওয়াব পাওয়ার জন্যে, বুঝে পালন করার জন্য নয়। তারা কখনও বুঝতে পারে না যে সত্য ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক রেখে তার প্রত্যেক কথার অনুসারে সৎভাবে জীবন যাপন করা। ধর্মযাজকের শিক্ষায় তারা মনে করে যে ধর্মের কাজ হল উপাসনার সমস্ত ক্রিয়াগুলো বিদেশী ভাষায় সঠিকভাবে উচ্চারণ করা। সৃষ্টিকর্তা যে প্রার্থনা বা উপাসনা গ্রহন করেন, তা যান্ত্রিক মুখস্থ-করা মন্ত্র নয়, তা হল অন্তরের কথার প্রকাশ, এবং অন্তরের কথা প্রকাশ হয় শুধু মাতৃভাষাতে। ঐশীভাষা-বিশ্বাসীরা অসংখ্য বছরের অধ্যয়ন নষ্ট করেছেন তাদের ঐশীভাষার রহস্যকর অক্ষরের ঐশী গুহ্যের সন্ধানে, সংস্কৃত হউক, আরবী হউক, বা চৈনিক-ভাষা হউক। এমনকি এই চিন্তার কারণে অনেকে সেই ঐশীভাষার সংকৃতি অনুসারে কাপড়-চোপর পরে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে। ব্যঙ্গার্থে তাদের নিজের ভাষা একদম আশাহীন নিম্ন ভাষা যার উৎকর্ষের কোনো লাভ নেই।
আবার ধর্মে বিবর্তন বা পরিবর্তন সহজে ঢুকে যায় যখন মাতৃভাষার অনুবাদের অস্বীকার করা হয়। ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান শুধু ধর্ম পেশাদারদের ব্যাখ্যার মারিফতে পাওয়া যায়, জনসাধারণ; মানুষ যারা সেই ঐশীভাষা ভালোভাবে আয়ত্ব করতে পারি না তারা সহজে ধর্মপেশাদারদের সব কথা বিশ্বাস করে, যদি তা কোন এক ঐশীভাষার বাক্য দিয়ে বলা হয়।
বৌদ্ধধর্মে এইরকম হয়েছে আজকাল, কারণ তারা মাতৃভাষার ধর্মীয় ব্যবহার অস্বীকার করেছেন। অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বর্তমানে যে ধর্ম করে তা গৌতম বৌদ্ধ যদি আজকাল বেঁচে থাকতেন তিনি চিনতে পারতেন না। সাধারন মানুষ যদি প্রাচীন পালি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ না পড়ে মাতৃভাষায় গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা পড়তেন তাহলে তারা বুঝতে পারতেন কীভাবে বোদ্ধধর্মের কেন্দ্রস্থল পরিবর্তন হয়ে গেছে – ব্যাক্তিগত ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি থেকে এখন শুধু ভিক্ষুসমাজ সংঘের সেবার মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া। আজকাল বোদ্ধ সমাজে যত মূর্তিপুজা হয়, জনগণ যদি মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়তেন তাহলে তারা বুঝতে পারতেন যে গৌতম বুদ্ধ মূর্তিপুজা অপচন্দ করতেন। কিন্তু ঐশীভাষার আড়ালে ধর্মপেশাদার সমাজ তাদের নিজের স্বার্থে এই অজ্ঞতা রক্ষা করেছেন শত শত বছর।
প্রচলিত “ঐশীভাষা” সমর্থন-যুক্তির উত্তর:“অমুখ ভাষা অন্যান্য সমনস্ত ভাষাদের আদী উৎস এবং মূল, ‘সমস্ত ভাষার মাতা’”
অনেক ভাষা এই দাবী করেছেন; সংস্কৃত, হিব্রু, আরবী। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান প্রমান করেছেন যে সমস্ত ভাষা বিবর্তন এবং পরিবর্তন করতে থাকে, এবং আজকাল কোন “সমস্ত ভাষাদের মাতা” এমন ভাষা নেই। যেমন ধরুন, পাঁচ হাজার বছর আগে আরবী ও হিব্রু ভাষা বিদ্যমান ছিল না – এরা পশ্চিম সেমিতীয় নামক অন্য একটি লুপ্ত ভাষা থেকে বিবর্তন হয়েছে, এবং সেই পশ্চিম সেমিতীয় অন্য একটি আরো প্রাচীন ‘আদী সেমিতীয়’ ভাষা থেকে বিবর্তন হয়েছে।
“অমুখ ভাষার বর্ণমালা এত সুন্দর যে দেখলেই বোঝা যায় সেটি স্বর্গীয় ভাষা”। ভাষার বর্ণমালাগুলোও বিবর্তন হয়েছে। হযরত মূসা (আঃ) এর আমলে আধুনিক হিব্রু অক্ষরের রূপ ছিল না- হিব্রু ভাষা লেখা হত প্রাচীন ফোনিষীয় ভাষার অক্ষরে (ইতিহাসের প্রথম বর্ণমালা)। হযরত ঈসা মসীহ্র আমলে আরবী বর্ণমালা আবিষ্কার হয় নি; আরবী অক্ষর খ্রীষ্টাব্দ চতুর্থ শতাব্দীতে ক্রমে ক্রমে বিবর্তন হয়েছে প্রাচীন আরামায় ভাষা থেকে, এবং কোর’আন শরীফ নাজেল হওয়ার আমলে দেখতে এইরকম ছিল:
হিব্রু বর্ণমালার আদী রূপ…….. আরবী বর্ণমালার আদী রূপ……..
হিব্রু, আরবী ও চীন লেখার সৌন্দর্য্য উন্নতি করেছেন পরে সেই ধর্মাবলম্বীদের শ্রমে, সেটা লেখাটার কোন স্থায়ী গুণ নয়। অনেক “ঐশী ভাষা” বিশ্বাসি ধর্মাবলম্বী অসংখ্য বছরের গবেষণার সময় নষ্ট করেছেন তাদের ঐশী ভাষার অক্ষরের পিছনে গুপ্ত আধ্যাতিক অর্থের খোঁজে, সংস্কৃত, হিব্রু, চীন বা আরবী হউক।
“অমুখ ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে গভীর ও সুন্দর ভাষা”। ভাষাবিজ্ঞানের বিদ্যার্থীরা এখন একমত যে প্রত্যেকটি ভাষা অন্তরের কথা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করাতে সমান। নিজের ভাষাকে একটি শ্রেষ্ঠ ভাষা মনে করা স্বাভাবিক, কিন্তু আসলে সমস্ত ভাষা সমানভাবে উন্নত।
“আমাদের ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা ব্যবহার করা উচিত কারণ সেটি আল্লাহ্র নিজের মুখের কথা”। আল্লাহ্ যদি ভাষা বলেন, আসলে যেকোন ভাষা যেটা দন্ত ব্যাঞ্জনবর্ণ ব্যবহার করে (যেমন আরবী) আল্লাহ্র দাঁত থাকতে হবে, এবং যেহেতু দাঁতের কাজ খাদ্য খাওয়া, বলতে হবে যে আল্লাহ্ আহার করেন। এই যুক্তির শেষ ফলাফল অরুচিকর।
“আমাদের মূল ভাষা ব্যবহার করতে হবে যেন মূল ধর্মের শিক্ষার পরিবর্তন না হয়”। আমরা আগে দেখিয়েছি কীভাবে মাতৃভাষার অর্থ ব্যবহারের বদলে বিদেশী মূল ভাষা ব্যবহার করার ফলাফল তার বিপরীত; বৌদ্ধ ধর্মে যেভাবে ধর্মের পরিবর্তন হয়েছে তেমনভাবে পরিবর্তন ঢুকে যেতে পারে। নিজের মাতৃভাষার প্রতি গর্ব করা স্বাভাবিক ও ভাল, কিন্তু সেটাকে একমাত্র “ঐশীভাষা” হিসাবে গণ্য করা অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহ্ সমস্ত ভাষাগুলো সমানভাবে গ্রহণ করেন।
ঈসা, ইঞ্জিল শরীফ, ও মাতৃভাষা: ঈসা এবং ইঞ্জিল শরীফ হচ্ছে এই সাধারন রীতির অনন্য ব্যতিক্রম। ঈসা মসীহ্ সাধারণ ইহুদী ধর্মীয় রীতি ভেঙ্গে তৌরাত শরীফের প্রাচীন হিব্রু ভাষার পরিবর্তে ইহুদী জনগণের চলতি আরামায় ভাষায় দীক্ষা দিয়েছেন। তেমনভাবে ইঞ্জিল শরীফ প্রাচীন সাহিত্যিক গ্রীক ভাষার পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষের চলতি ‘কোইনে’ গ্রীক ভাষা ব্যবহার করেছে। এইভাবে ঈসা মসীহ্ ধর্মীয় পেশাদারদের হাত থেকে তাঁর শিক্ষাকে রক্ষা করেছেন, কারণ আন্তরজাতিক চলতি ভাষায় কিছু চড়িয়ে পরলে তা কোন ছোট জাতির পন্ডিতগণ বা ধর্মীয় পেশাদার শ্রেণীর পক্ষে তা ঐশীভাষায় ঢেকে রাখা বা নিজ-স্বার্থে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আবার ঈসা মসীহ্র জামাতের উদ্বোধনের দিনে আল্লাহ্-পাক স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন যে তাঁর এবাদত করতে প্রত্যেকটি ভাষা সমান- আল্লাহ্র পাক-রূহ্র কুদরতে ঈসা মসীহ্র সাহাবীগণ অলৌকিকভাবে বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহ্র প্রশংসা করলেন। সেদিন ছিল ইহুদীদের হজ্জের মত একটি বিরাট বার্ষিক সম্মেলন, এবং বিভিন্ন জাতির হাজার হাজার আল্লাহ্ভক্ত লোক তখন জেরুজালেমে প্রাচীন হিব্রু ভাষায় এবাদত করতে এসেছেন। তারা যখন সেদিনে সাহাবীগণের মুখে নিজ নিজ ভাষা আল্লাহ্র এবাদত-বন্দেগী শুনতেন তারা আশ্চর্য হলেন – আরবী ভাষায়, ফারসী ভাষায়, গ্রীক ভাষায়, ইত্যাদি।
শত বছর পরে, রোম শহরের ক্যাথলিক চার্চ তাদের নিজের ল্যাটিন ভাষাকে ঐশীভাষায় হিসাবে জারি করেছেন, কিন্তু শেষে তা ব্যর্থ হয়েছে। মার্টিন লুথারের মত লোক যারা জানতেন ঈসা মসীহ্ কতটুকু মাতৃভাষার উপর জোর দিতেন তারা এই ভন্ডামির অস্বীকার করে মাতৃভাষায় এবাদত ও মাতৃভাষায় কিতাব পড়ার প্রথা ফিরিয়ে এনেছেন। ইতিহাসে ঈসা মসীহ্র অধিকাংশ অনুসারীরা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে ঐশীভাষা চিন্তাধারা অস্বীকার করে এবাদতে মাতৃভাষা ব্যবহার মেনে নিয়েছেন। আসলে ইতিহাসে দেখা যায় যে বিভিন্ন জাতি ও দেশে অবজ্ঞাত মাতৃভাষা তুলে আধুনিক ভাষায় রূপান্তর করার প্রধান শক্তি বা কারণ হচ্ছে বিভিন্ন ভাষায় কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ।
কিতাবুল মোকাদ্দস অন্যন্য বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকমাত্রায় প্রকাশ হওয়ার বই এবং ইতিহাসে কিতাবুল মোকাদ্দস হচ্ছে অন্যান্য বই বা ধর্মগ্রন্থের চাইতে সবচেয়ে বেশী ভাষায় অনুবাদ করা বই। কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদের অংশ আছে দুই হাজার ভাষায়, এবং পূর্ণ কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ আছে ৪০০ ভাষায়। বর্তমানে অন্য ৭০০ ভাষার অনুবাদের প্রকল্প চলছে যেন বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতির মানুষ মাতৃভাষায় আল্লাহ্র কালাম পড়তে পারে। অন্যান্য সব ধর্মগ্রন্থের চাইতে কিতাবুল মোকাদ্দস দশগুণের বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। যেমন কোর’আন শরীফ অনুবাদ করা হয়েছে কেবল ৬০টি ভাষায়। মুদ্রাযন্ত্রে চালনীয় মুদ্রাক্ষরে ইতিহাসে সর্বপ্রথম ছাপানো বই হচ্ছে কিতাবুল মোকাদ্দস। পাঁচশত বছর আগে এই কিতাবুল মোকাদ্দসের মুদ্রণ গণশিক্ষায়, অক্ষরতায়, এবং তথ্য-প্রচারে একটি বিশ্বব্যাপি বিপ্লব বা বিবতর্ন ঘটালো। গুটেনবার্গ, যিনি সেই প্রথম মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, তাঁর উদ্যোগের উদ্দেশ্য এইভাবে প্রকাশ করেছেন:
“এটি একটি মুদ্রাযন্ত্র, অবশ্যই, কিন্তু একটি মুদ্রযন্ত্র যেখান থেকে বহে যাবে অশেষ প্রবাহ … এটার মাধ্যমে আল্লাহ্ তার কালাম ছড়িয়ে দিবে। এই প্রেস থেকে সত্যের একটি ঝর্ণা বয়ে যাবে; একটি নতুন তারার মত সেটা অজ্ঞতার অন্ধকার হটাবে, এবং মানব জাতির মধ্যে জ্বালাতে দেবে এক নতুন জ্যোতি।”
গুটেবার্গের সেই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হল; যখন জনগণের ঘরে ঘরে প্রতিদিন কিতাব পড়ার অভ্যাস প্রচলন হল, তখন সততার, নিষ্ঠা এবং শ্রমের একটি ধার্মিক পুনর্জাগরণ ঘটল। এই পুনর্জাগরণের ভিত্তিতে উত্তর ইউরোপের উনবিংশ শতকের আকস্মিক ক্রয়বিক্রয় বৃদ্ধি ও বিজ্ঞানের পুনর্জনম ঘটল, কারণ গণশিক্ষায় মাতৃভাষার উপর জোর না দেওয়া পর্যন্ত কোন সমাজ আর্থিক উন্নতি পেতে পারে না। ইউরোপে সেই কিতাবুল মোকাদ্দসের প্রচন্ড প্রভাব ফেলল; জার্মান ভাষাবীদগণ বলে যে আধুনিক জার্মান ভাষার আকারের মূল হচ্ছে মার্টিন লুথারের সেই প্রথম জার্মান বাইবেলের অনুবাদ। তেমনিভাবে ইংরেজ সাহিত্যের প্রধান প্রভাব হচ্ছে বাইবেলের প্রধান ইংরেজী অনুবাদ।
এত জাতির ভাষায় কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করার উদ্যোগের উদ্দেশ্য কি? হযরত ঈসা তাঁর উম্মতদের জন্য একটি নমুনা রেখেছে বিদেশী ভাষা ব্যবহার না করে অবজ্ঞাত মাতৃভাষা তুলে ব্যবহার করতে। ঈসা মসীহের শিক্ষা কোন এক জাতির ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মত ছিল না বরং জনগণকে সয়তানের অন্ধকার থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে।
বর্ণমালা আবিষ্কার এবং গণ-অক্ষরতা শিক্ষা
দৃষ্টত মানুষের চলতি ভাষায় কিতাব অনুবাদ করার বেশি লাভ নেই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিরক্ষর থাকে। এইজন্য ঈসা মসীহের অনুসারীগণ বিভিন্ন ভাষায় প্রথম বর্ণমালা আবিষ্কার করার কঠিন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, এবং তার পরে মানুষদের সেই বর্ণমালায় অক্ষরতা শিক্ষা দিতে যেন সবাই আল্লাহ্র কালাম বুঝে পড়তে পারতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ আধুনিক সিরিলীয় বর্ণমালা যেটা রুশ ভাষায় এবং অন্যান্য ১০০ ভাষায় ব্যবহার হয় সেটা নবম শতকে আবিষ্কার করেছেন সিরিল এবং মেথোদিয়স নামে দু’জন ঈসায়ী তবলীগকারী কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করতে যেন স্লাাভিক জাতি নিজ মাতৃভাষায় কিতাব পরতে পারতেন। তার আগে সেইসব ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা ছিল না। তেমনিবভাবে আধুনিক ভিয়েট্নামী ভাষার বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন ৪০০ বছর আগে একজন ঈসায়ী ধর্মপ্রচারক কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করতে। এমনভাবে আরো ২০০ ভাষার বর্ণমালা (যেমন ক্রী, আর্মিনিয়, গোথিক, ইত্যাদি) আবিষ্কার করেছেন ঈসায়ী তবলীগকারীরা।
কোরিয়াতে ‘হাঙ্গুল’ নামে একটি সহজ যুক্তিপূর্ণ বর্ণমালা আবিষ্কার হয়েছে ৬০০ বছর আগে যাতে সাধারন মানুষ সহজে লেখাপড়া শিখতে পারতেন। কিন্তু বৌদ্ধ এবং কন্ফুশিয় ধর্মীয় নেতারা এর বিরধিতা প্রকাশ করে সেই বর্ণমালা নিষিদ্ধ করেছেন কারণ সেটা “ঐশী” চীন অক্ষরে ছিল না। এইজন্য লেখাপড়া শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর একটি অবসর বিনোদন থেকে গেল। সেই সহজ বর্ণমালা শত বছর ধরে অবহেলিত ছিল বিংশ শতক পর্যন্ত। সেই সময় ঈসায়ী তবলীগকারী এসে কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করেছেন সেই অবহেলিত সহজ যুক্তিপূর্ণ বর্ণমালায়, কোরিয়ার প্রথম সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে কোরিয়াতে অক্ষরতা উৎসাহিত করলেন। এই বর্ণমালা পরিবর্তনের ফলে দেশে অক্ষরতা, জাতিয়তাবাদ স্বাতস্ত্র্য এবং আর্থিক উন্নতি বেড়ে গেল। আফ্রিকাতে এইরকম অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যেখানে কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদের ফলে একটি অবহেলিত ভাষার পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছেন।
এইভাবে আমরা বিশ্বজগতে দেখতে পায় কিতাবুল মোকাদ্দস বিভিন্ন মাতৃভাষায় অনুবাদের ফলে ক্রমাগতভাবে গণ অক্ষরতা, গণতন্ত্র, উন্নতি এবং উচ্চশিক্ষা বিস্তার হয়েছে। আমাদের নিজের বাংলা ভাষা এর কোন ব্যতিক্রম নয়। বঙ্গের ঐতিহাসিক রীতি অনুসারে আরবী, সংস্কৃত এবং ফারসি ভাষাগুলো ধর্মীয় শিক্ষায় এবং উপাসনায় প্রধান স্থান পেয়েছেন বাংলা ভাষার উপরে। এই মনোভাবের ফলে এখনও হাজার নিম্নশ্রেণীর বাঙালী আছে যারা আরবী পড়তে পারেন কিন্তু নিজের মাতৃভাষায় নাম পর্যন্ত আগাগড়া কিছুই লিখতে পারেন না।
শত বছর ধরে বঙ্গের প্রায় সব ইতিহাস ফারসি এবং সংস্কৃত ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রবিন্দ্রনাথের শুধু দশ দশকের পূর্বে কলকাতায় একজনও যোগ্যতাসম্পন্ন বাংলা ভাষার শিক্ষক ছিল না; বাংলা ভাষায় কোন গদ্য ছিল না, অভিধান বা শব্দকোষ ছিল না, ব্যাকরণ ছিল না, ছাপানো বইও ছিল না। এটা আশ্চর্য কিছু নয়, কারণ সেকালের মধ্যযুগের হিন্দু ও মুসলমান পন্ডিতগণদের চিন্তায় বাংলা ভাষা ছিল নিম্ন নারী ও ভূতদের উপযুক্ত ভাষা মাত্র, গরীব জেলেদের অসম্মানীত একটি ভাষা যেটা রাজাদের প্রসাদে ব্যবহার করা অনুপযুক্ত। ১৮০০ শালের পূর্ব যে কয়’টা বাংলায় লিখিত কাব্যের রচনা ছিল সেগুলো অধিকাংশ ফারসি ও সংস্কৃত কাব্যের অনুবাদ ছিল এবং ফারসি ও সংস্কৃত মূলের চেয়ে কম প্রচারণ পেল।
যদিও ইসলাম আটশত বছরের বিস্তার পেল, বঙ্গে কোরআন শরীফের অর্থ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষদের খুব কম প্রত্যক্ষসূত্রে জ্ঞান ছিল। কোরআন শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদ ১৮৮০ শালে করেছেন গিরিশ চন্দ্র সেন নামে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। (যঃঃঢ়://িি.িয়ঁৎধহ.ড়ৎম.ঁশ/ধৎঃরপষবং/রবনথয়ঁৎধহথঃৎধহংষধঃড়ৎং.যঃস) ইংরেজ ঔপনিবেশকরা বাংলা ভাষার ব্যবহার উৎসাহিত করেন নি; তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল ক্ষমতা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাতে তারা ভারত থেক অর্থসম্পদ বের করে এনে নিতে পারে। তারা ফারসি ভাষা এবং পরে ইংরেজী প্রশাসনে ব্যবহার করলেন। ইংরেজ প্রাচ্যবীদরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিরোধ করেছেন, তার বদলে সংস্কৃত, আরবী এবং ফারসি ভাষায় গণশিক্ষার পরিকল্পনা সমর্থন করেছেন। এমন পর্যন্ত রামমহন রয়ের মত বঙ্গ পুনর্জনমের নেতারা মনে করতেন যে বাংলা ভাষা উপাসনায় অযোগ্য এবং ইংরেজী বাষায় গণশিক্ষার পরিকল্পনা সমর্থন করতেন। তাহলে সাহিত্যে, শিক্ষায়, প্রশাসনে এবং ধর্মে বাংলা ভাষাকে সর্বপ্রথম কারা সম্মান দিতেন? কারা বাংলা ভাষাকে প্রথম তুলে নিলেন এবং কেন এই মনোভাবের পরিবর্তন হল?
বঙ্গের সর্বপ্রথম মাতৃভাষার আন্দোলন; বাংলা ভাষার প্রথম…
বাংলা ভাষার প্রথম ‘মাতৃভাষা আন্দোলন’ করেছেন ঈসা মসীহের অনুসারীদের একটি ছোট দল দুই’শ বছর আগে। এই প্রথম মাতৃভাষার আন্দোলনের শুরু হয় প্রধানত একজন গরিব স্বশিক্ষিত মুচির দ্বারা। তাঁর নাম উইলিয়ম কেরী, এবং বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষে বাংলাপিডিয়া-তে কেরীকে বলে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ এবং ‘শ্রীরামপুরে নবজাগরণের স্রষ্টা’। “উনবিংশ শতকে বাংলা সাহিত্য” গ্রন্থে অধ্যাপক এস.কে. দে বলেন যে কেরী এবং তার সহকর্মীরা “বাংলা ভাষাকে ভাঙ্গা এবং অসম্মানিত আঞ্চলিক উপভাষার অবস্থা থেকে তুলে সেটাকে এরা একটি সুখ্যাতি ও স্থায়ী আধুনিক ভাষায় পরিনত করেছেন।” বাংলাপিডিয়া আরো বলেন:
“…এ ক্ষেত্রে অবশ্য কেরীর অবদানই বেশী। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে কেরী যে অবদান রাখেন, তার জন্য তিনি বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)
কেরী ষোল বছর বয়সে কিতাবুল মোকাদ্দস পড়ে ঈসা মসীহের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঈসার অনুসারী হয়। নিম্ন ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’ থেকে বহু উদ্দৃতি দেওয়া থাকবে:
“দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত কেরীকে জীবিকার জন্য জুতা তৈরির কারখানায় কাজ করতে হয়। ষোলো বছর বয়সে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু ভাষা এবং ইতিহাস, ভূগোল, ভ্রমণকাহিনী, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জ করেন। (বাংলাপেডিয়া, “কেরী, উইলিয়ম”)
ভূগোল ও ভ্রমণকাহিনী পড়তে কেরী শিখেছেন কিতাবুল তখনও মোকাদ্দস ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয় নি। এই শুনে কেরী মনে ঠিক করেন ঈসা মসীহের শেষ হুকুম (বিভিন্ন জাতির কাছে সুসংবাদ তবলীগ করা) অনুসারে তিনি ভারতে আগমন করবেন। যাওয়ার পূর্বে, কিতাবুল মোকাদ্দস সঠিকভাবে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে তিনি হিব্রু ও গ্রীক ভাষা শিখেন। মিশনবিরোধী ইংরেজ সরকারের বিতাড়ন এড়াতে কেরী দিনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি মৃত্য পর্যন্ত থাকলেন। ১৭৯৯ সালে জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড মিশনেরিরা কেরীর সাথে একটি প্রেস স্থাপন করেন এবং এই “শ্রীরামপুর ত্রয়ী” একসাথে প্রায় চল্লিশ বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন বাংলা ভাষা ও গণশিক্ষার উৎকর্ষ সাধন করার জন্যে।
প্রথম বাংলা গ্রন্থ : ইতিহাসে বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ছিল কেরীর মঙ্গল সমাচার (ইঞ্জিল শরীফের বঙ্গানুবাদ): “এভাবে আগস্ট মাসের মধ্যেই নিউটেস্টামেন্টের সেন্টম্যাথুজ ছাপা হয়। মথীয়ের রচনায় মঙ্গল সমাচার নামে এটি প্রকাশ করা হয়। এটি বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ। (বাংলাপেডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)।
প্রথম বাংলা সংবাদপত্র: বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম সংবাদপত্র ছিল কেরীরও কাজ: “বাংলায় সাময়িক পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদপত্রের সূচনা বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে বিনির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বিবিধ সাময়িক পত্র-পত্রিকা নানাভাবে সাহায্য করেছে, যার ধারা একাল পর্যন্ত অব্যাহত। শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের কৃতিত্ব অর্জন করেন…” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)। প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র: বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম সাময়িক পত্র, ‘দিগ্দর্শন’ ছিল কেরীরও উদ্যোগ: “প্রথম দিকে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে মুদ্রণযন্ত্র, হরফের অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল প্রধান প্রতিবন্ধক। কারণ ঐ সময় যাঁরা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা কেউ কোম্পানির চাকুরে ছিলেন না। কোম্পানির সঙ্গে ছিল তাঁদের স্বার্থগত এবং নীতিগত বিরোধ। … বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে মিশনের পক্ষে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র দিগ্দর্শন। … দিগ্দর্শন প্রকাশিত হওয়ার একমাস পর (২৩ মে, ১৮১৮) মার্শম্যান প্রকাশ করেন সমাচার দর্পণ। (বাংলাপিডিয়া, “সংবাদপত্র”)
শ্রীরামপুরের ধর্মপ্রচারকগণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিলেন। জে. সি. মার্শম্যানের দিগ্দর্শন, ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ (ইংরেজি ও বাংলায়), সমাচার দর্পণ (১৮১৮ সালে প্রকাশিত) ও দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া (ঐ একই সালে প্রকাশিত) কতিপয় সমকালীন সামাজিক সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
প্রথম বাংলা অভিধান: অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ কেরির সম্পর্কে লিখেছেন এইভাবে: উইলিয়ম কেরি। স্মরণীয় তিনি বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে, অবিস্মরণীয় বাঙলা অভিধানের ইতিকথায়। ফরস্টারের পর দেড় দশকের মধ্যে যখন বেরোয় উইলিয়ম কেরির বিশাল অভিধান, তখন নিশ্চয়ই বাঙলা ভাষা তাঁর দিকে তাকিয়েছিলে। মুগ্ধ, বিস্মিত, কৃতজ্ঞ চোখে। কেরির অভিধানের নাম এ ডিকশনারি অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়র্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন, অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন। এর প্রথম খন্ড বেরোয় ১৮১৫-তে; …কেরির অভিধান অনেক বেশি সুদৃশ্য ও সুশৃঙ্খল ফরস্টারের অভিধানের চেয়ে। শব্দের পরিমাণও অনেক বেশি, বিচ্যুতিও অনেক কম। তিনি প্রায় স্থির ক’রে ফেলেন অধিকাংশ বাঙলা শব্দের সংস্কৃতানুসারী বানান। সে-কালের প্রধান গদ্য লেখকদের বানানে যে-অস্থিরতা দেখা যায়, তা নেই এ-অভিধানে। কেরি বহু শব্দ নিয়েছেন সংস্কৃত অভিধান থেকে, বহু শব্দ নিয়েছেন বাস্তব জীবন থেকে, এবং নিজে তৈরি করেছেন প্রচুর শব্দ। … কেরির অভিধান বেশ সুস্থির ক’রে দেয় বহু বাঙলা শব্দের রূপ ও বানান; এবং আধুনিক বাঙলা মানভাষার বিকাশে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেরি যদি বাঙালি হতেন, তাহলে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন আরো বেশি। মহিমা পেতেন বাঙলা ভাষার প্রধান অভিধানপ্রণেতার। তাঁকে বলতাম বাঙলা অভিধানের জনসন।
কেরীর রচিত বাংলা অভিধান জনপ্রিয়তা পেলেও প্রথম অভিধান ছিলেন না; এঁর আগে আর একজন ঈসায়ী প্রচারক এই কৃতিত্ব অর্জন করেন: “প্রথম বাংলা অভিধান ঠড়পধনঁষধৎরড় বস ওফরড়সধ ইবহমধষধ ঊ চধৎঃঁমঁবু নামে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ কর্তৃক সংকলিত হয়।” (বাংলাপিডিয়া, “অভিধান”)
প্রথম বাংলা জ্ঞানকোষ: “বঙ্গে সর্বপ্রথম জ্ঞানকোষের উদ্যোগ করলেন ফিলিক্স কেরী, উইলিয়ম কেরীর পুত্র। তার বিদ্যাহারবলী (১৮১৯-২১) ছিল ছোটদের তথ্যের বই।” (বাংলাপিডিয়া, প্রধান সম্পাদকের ভূমিকা”); প্রথম বাংলা পাঠ্যপুস্তক-এই ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী”এর দ্বারা বাংলা ভাষার প্রথম পাঠ্যপুস্তকগুলো রচনা করা হল:
“কেরীর নেতৃত্বে একদল বাঙালি পন্ডিত বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজ শুরু করেন। এভাবে কেরী এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার একটি পরিকল্পিত ধারার প্রবর্তন ঘটে।” (বাংলাপিডিয়া, “বাংলা সাহিত্য”)।
অন্য প্রবন্ধে বাংলাপিডিয়া আরও বলেন: “বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের কৃতিত্বের কারণে তাঁকে ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষাও পড়াতেন। ঐ সময়ে কলেজ পর্যায়ের উপযুক্ত বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অভাবে ছিল। এ বিষয়টি অনুভব করে কেরী বাংলা ব্যাকরণ ও কথোপকথন (১৮০১) প্রকাশ করেন। ১৮১২ সালে প্রকাশিত হয় তার ইতিহাসমালা। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছেঃ নিউ টেস্টামেন্ট, ওল্ড টেস্টামেন্ট ও বাংলা-ইংরেজি অভিধান।” (বাংলাপিডিয়া, “উইলিয়ম কেরী”)
প্রথম বাংলা বাঙালি-লিখিত গদ্যের মৌলিক গ্রন্থ : বাঙালী লিখিত ও বাংলা গদ্যের মুদ্রিত প্রথম মৌলিক গ্রন্থ লিখেন অন্য একজন খ্রিষ্ট-অনুসারী:
“ৃ১৮০১ সালে রামরাম বসু রাজা প্রতিপাদিত্য চরিত্র নামক একখানা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন; এটি বাঙালী লিখিত ও বাংলা গদ্যের মুদ্রিত প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। গ্রন্থখানি শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। ৃএর পূর্বে তিনি প্রথম বাংলায় খ্রীষ্টস্তব (১৭৮৮), গসপেল মেসেঙ্গার অনুসরণে ১০০ পঙক্তির হরকরা (১৮০০) কাব্য এবং খ্রীষ্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার ও হিন্দুধর্মের নিন্দা করে জ্ঞানোদয় (১৮০০) কাব্য প্রকাশ করেন। তাঁর অপর দুটি গ্রন্থ হলো লিপিমালা (গদ্যগ্রন্থ, ১৮০২) ও খৃষ্টবিবরণামৃত (খ্রীষ্টচরিত, ১৮০৩)। ১৮০২ সালে দুটি ইংরেজি খ্রিষ্টসঙ্গীত তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। এছাড়া বাইবেলের বাংলা অনুবাদে তিনি কেরীকে সাহায্য করেন। (বাংলাপেডিয়া, “রামরাম বসু”)।
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস: উইলিয়ম কেরী ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে বাংলা ভাষার জন্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন।
“ৃশ্রীরামপুর প্রাচ্যে মুদ্রণ শিল্পে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। . . . ১৮০০-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪৫টি ভাষায় ২,১২,০০০ বই ছাপা হয়। সমকালীন বিশ্বে খুব কমসংখ্যক প্রেসই এ ধরনের কৃতিত্বের অধিকারী ছিল।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)।
শ্রীরামপুর মিশন মুদ্রণ ও প্রকাশনা ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিল। কেরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ। তাঁর নির্দেশনায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস পূর্ণাঙ্গ বাইবেলের বাংলা, অহমীয়, উড়িয়া, হিন্দি, মারাঠি ও সংস্কৃত অনুবাদ ছাপায়। বাইবেলের অনুবাদ ছাড়াও ব্যাপ্টিস্টগণ ও তাঁদের ভারতীয় সহযোগীবৃন্দ (যেমন, রামরাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) রামায়ণ ও অন্যান্য ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের অংশ বিশেষ অনুবাদ করেন। তাঁরা বহুসংখ্যক গবেষণামূলক প্রবন্ধ অথবা প্রচারণমূলক পুস্তিকা (১৮২৯ সাল নাগাদ প্রায় ৩৩,০৫০টি) অনুবাদ, মুদ্রণ ও বিতরণ করেন। এ দৃষ্টান্ত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটিকে (১৯১৭) ১৮২১ সাল নাগাদ বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রকাশনাসমূহ সন্দেহাতীতভাবে বাংলা গদ্য সাহিত্যের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)।
বাইবেলের বাংলা অনুবাদ, হিতোপদেশ ও কথোপকথন নামে তিনখানা পুস্তক ছাপা হয় মিশন প্রেস থেকে। কেরীর মুন্সী রামরাম বসু প্রকাশ করেন প্রতিপাদিত্য চরিত, রামায়ণ ও মহাভারতের বাংলা অনুবাদ।।… মিশনারিদের আর একটি অবদান হলো শ্রিরামপুরে ভারতে প্রথম বাষ্পীয় কাগজ কল স্থাপন করা। ১৮০১-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪০টি ভাষায় মোট ২,১২,০০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সকল উন্নয়নে শ্রীরামপুরের স্থানীয় জনসাধারণ প্রায়শই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। মিশনারিদের জনশিক্ষা বিস্তার, প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সমাজ সংস্কারমূলক যেকোন ধরনের কাজে শ্রীরামপুরের অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)। সততা, নির্ভরশীলতা, ব্যয়ে স্বল্পতা, উন্নত মুদ্রণ প্রভৃতির জন্য অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীরামপুরের মুদ্রণ শিল্প সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এরূপ উন্নত মুদ্রণশালার অস্তিত্ব পছন্দ করে নি। তারা প্রেসটি বন্ধ করে দিতে বারবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেন্মার্ক সরকারের জন্য তা সম্ভব হয় নি। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন প্রেস”)।
সেই মুদ্র শিল্প এশিয়ার সবচেয়ে বড় ছাপাখানার পদ পাওয়া ছাড়া বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে বড় ছাপাখানা ছিল, এবং শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে চল্লিশ ভাষায় দুই লক্ষ বই প্রকাশ হয়েছে। বাংলাপিডিয়া এভাবে বলেন: “শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিশন প্রত্যক্ষভাবে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে দেশে নবজাগরণের পথও প্রস্তুত হয়। মিশন এ সময় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বহু স্থানে তাদের শাখা স্থাপন করে।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)। বাংলা গদ্য সাহিত্য প্রসারেও মিশন পথিকৃতের ভূমিকা গ্রহণ করে।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)।
শ্রীরামপুর মিশনের গনশিক্ষা কার্যক্রম: বাংলা-মাধ্যম প্রশিক্ষনে এবং অক্ষরতায় কেরী ছিলেন প্রবর্তক বা অগ্রদূত। কেরীর আগমনের পূর্বে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ উচ্চশ্রেণী সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সেটা ছিল প্রধানত লম্বা লম্বা আরবী বা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা বা শাস্ত্র মুখস্থ করে ফেলা। জনসাধারণ অক্ষরতার শতকরা হার অতীমাত্রায় কম ছিল, এবং তখন বাংলা ভাষায় নয় কিন্তু সংস্কৃত বা আরবী ভাষায়। রামমোহন রয়ের মত পরের পন্ডিতগণ যখন ইংরেজীকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম আনতে চাচ্ছিল, কেরী জোর করে বলতেন যে বাংলা ভাষাকে বঙ্গের উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত।
যে যুগে নারীদের অজ্ঞতা এবং বিবিক্তকরণে রাখা তাদের সতীত্বের একটি প্রয়োজনীয় অংশ বলে সমাজ মনে করত, সেই সময় শ্রীরামপুর মিশন সেই অঞ্চলের প্রথম মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। বিশাল মঙ্গলবাদী, কেরীর সম্পর্কে ভারতের একজন বিশেষজ্ঞ “ঞযব খবমধপু ড়ভ ডরষষরধস ঈধৎবু” [“উইলিয়ম কেরীর অবদান”] গ্রন্থে লিখেছেন: “ভারতের সব জাত ও শ্রেণীর ছাত্রের জন্যে কেরী ডজন-ডজন স্কুল স্থাপন করেছেন এবং এশিয়ার সর্বপ্রথম ডিগ্রি কলেজ তিনি শুরু করেছেন শ্রীরামপুরে। তিনি ভারতীয় মনকে উন্নতি করতে ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেক মুক্ত করতে চাইতেন। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ভারতের ধর্মীয় সংস্কৃতি অধিকাংশ ভারতীয় মানুষদের তথ্যের স্বাধীন প্রবেশাধিকার থেক নিরোধ করেছেন; এবং হিন্দু, মুঘল ও ইংরেজ নেতারা এই জনগণকে অজ্ঞতার বন্দীদশায় রাখা উচ্চশ্রেণীর কৌশলের পথে থাকল। ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কেরী মহৎ আত্মিক শক্তি দেখাল, যারা নিজ সুবিধার জন্যে জনগণকে সত্যকে জানার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা থেক বিরত রাখতেন।”
বা বাংলাপিডিয়ার অন্য এক প্রবন্ধে: “শ্রীরামপুরের পার্শ্ববর্তী বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে শতাধিক মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হ্যানা মার্শম্যান স্থাপন করেন প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু উইলিয়ম কেরী ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন, যেখানে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি কাঠের হরফ ব্যবহৃত হতো। ১৮১৮ সালে কেরী ও তাঁর দুই সহকর্মী তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করেন শ্রীরামপুর কলেজ। এটি এশিয়ার মধ্যে প্রথম ডিগ্রি কলেজ। কেরী বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে লাভ করেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)। প্রথম সময়কাল-অর্থাৎ কেরীর আমলে – প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিসাধন এবং শিক্ষা বিস্তারের ওপর। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
প্রাথমিকভাবে মাতৃভাষার প্রতি সহানুভুতিশীল হলেও শ্রীরামপুর ত্রয়ী গ্রাম্য পাঠশালার ওপর ভিত্তি করে বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থায় খ্রিষ্টান ধারণাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের নিকট শিক্ষা পৌঁছে দিতে ‘সরদার-পড়য়া’র মতো দেশী ব্যবস্থা গ্রহণ করে কেরী জনগণের শিক্ষার একটি কার্যক্রম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
১৮৩০-এর দশকে ইংরেজদের দ্বারা প্রচলিত রীতি হিসেবে চালু করা শিক্ষার ব্যাপারে ‘নিচ দিকে উপচে পড়া তত্ত্বে’ কেরীর কোন আস্থা ছিল না এবং তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিচ দিক থেকে গড়ে উপরের দিকে তুলতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর সহযোগী জে. মার্শম্যান ১৮১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে মাতৃভাষা শিক্ষাদানকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ‘স্থানীয় স্কুল সম্বন্ধে আভাস’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে জোর দেওয়া হয় যে, শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত জনগণের মাতৃভাষা। গ্রামের স্কুলসমূহের উচিত পাটিগণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোলের মোটামুটি প্রধান অংশসমূহ, প্রাকৃতিক দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘উন্নত’ পাঠক্রম অনুসরণ করা। এ কর্মপরিকল্পনা আপাতভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়; ১৮১৮ সাল নাগাদ ৬,৭০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাপ্টিস্টদের ‘নন্-কন্ফর্মিস্ট নীতি-বোধ’ প্রারম্ভে তাঁদেরকে কোনপ্রকার রাষ্ট্রিয় সাহায্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে।
একজন সত্যিকার ‘খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ’ হিসেবে কেরী তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় সনাতন ও মাতৃভাষা সংক্রান্ত ধারণাসমূহকে সংযুক্ত করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এর (১৮০০) একজন অধ্যাপক এবং এশিয়াটিক সোসাইটির (১৮০৬) একজন সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে তিনি প্রাচ্যদেশীয় সনাতন বিদ্যাসমূহের অধ্যায়নকে উৎসাহিত করেছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপনের পথ সহজ করে তোলার জন্য বাইবেলকে সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা উচিত। যদিও মুখ্যত তিনি মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার একজন চার্টার অ্যাক্ট পাসের পর ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি সরকারি অনুদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার প্রণীত ভারতের দেশীয় অধিবাসীদের ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের পরিকল্পনাকে (জুন, ১৮১৪) ভারতে প্রথম সর্বাত্মক শিক্ষাদানের প্রোগ্রাম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর ত্রয়ী এশীয় যুবাদের প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ শিক্ষা দান করতে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
শ্রীরামপুরের এই পাদ্রী ত্রয়ী খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার পাঠ্যসূচিতে আধুনিক বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁরা এসব স্কুলের জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রেস থেকে সেসব প্রকাশ করেন। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁরা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করেন। এই সোসাইটি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ব্যবহারের জন্য উপর্যুক্ত গ্রন্থসমূহের হাজার হাজার কপি মুদ্রণ করে। … পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্টরা বাংলা ভাষায় উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”)
সামাজিক ব্যাধি ——- “শ্রীরামপুরের যাজকরা সমকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত অমানবিক আচরণ, যেমন সাগরদ্বীপে শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সরকারকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন; এসবের ওপর তাঁরা একটি গবেষণাও চালিয়েছিলেন।” (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”) । শ্রীরামপুর ত্রয়ী কিছু হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আচারানুষ্ঠান, যেমন জাতিভেদ প্রথা, সতী, শিশুহত্যা, অন্তর্জলি (রুগ্ন ব্যক্তিদের নদীর তীরে অনাবৃত অবস্থায় ফেলে রাখা), ইত্যাদির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৮০৪ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রকম কিছু আচারকে নিষিদ্ধ আইন পাসে তাঁরা সহায়ক ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, শুধু খ্রিষ্টানদের সত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষাই এ সামাজিক ব্যাধিসমূহ দূর করতে পারে। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টান মিশনারি”)
শ্রীরামপুর মিশনের অন্যান্য অবদান: বাংলা ভাষায় কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করার পরে কেরী তেমনভাবে মূল হিব্রু ও গ্রীক পান্ডুলিপি থেকে কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ করেছেন ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক ভাষায়। ভারতবর্ষের মাতৃভাষা ও উপভাষার প্রথম বিস্তৃত জরিপ-মানচিত্র তিনি করেছেন। কেরী সবার আগে ভারতের মহৎ সাহিত্যের গ্রন্থ ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করেছেন, যেমন রামায়ণ ও সংখ্য। তিনি পান্ডিত্যপূর্ণ প্রথম সংস্কৃত অভিধান বা শব্দকোষ লিখেছেন।
ঈসা মসীহের আদর্শের অনুসারে কেরী বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে সমস্ত জাতির ভাষা এবাদত ও কিতাব পড়ার যোগ্য। এই ক্ষেত্রে তিনি পরবর্তি প্রগতিশীল পন্ডিতদের চেয়ে প্রাগ্রসর ছিলেন, যেমন রামমহোন রয় যিনি বিশ্বাস করতেন যে শুধু সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজী উপাসনায় গ্রহণযোগ্য ছিল। ইতোমধ্যে কেরী বাংলা ভাষায় শ্রষ্টার উপাসনার জন্য নিজে একশর বেশি সঙ্গীত রচনা করেছেন, রবিদ্রনাথের অনেকদিন পূর্বে। তিনি ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়ও বাইবেলের অনুবাদ ও অভিধান প্রকাশ করেন। ১৮২৯ সালে তিনি সতীদাহ নিবারক আইন অনুবাদ করেন। কেরী ভারতীয় কৃষি, ভূবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা সম্বন্ধেও প্রচুর গবেষণা করেন। ১৮২৩ সালে তিনি ভারতে ‘এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি’ স্থাপন করেন। তিনি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া নামে একটি ইংগ্রেজি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। আধুনিক যুগের শুরুতে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের প্রচলন, বাংলা ভাষার ব্যাকারণ ও গদ্যগ্রন্থ রচনা এবগ্ন সেগুলি প্রকাশের জন্য একজন বিদেশী হয়েও উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একটি বিশষ স্থান দখল করে আছেন।” (বাংলাপিডিয়া, “উইলিয়ম কেরী”)। কেরী শ্রীরামপুরে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সেখানে বাগান তৈরি করেন এবং বিদেশ থেক বীজ এনে নতুন জলবায়ু গ্রহণে সক্ষম বৃক্ষ উৎপাদন করেন। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া স্থাপনেও নেতৃত্ব দেন। (বাংলাপিডিয়া, “খ্রিষ্টধর্ম”)।
“…মিশনারিদের আর একটি অবদান হলো শ্রিরামপুরে ভারতে প্রথম বাষ্পীয় কাগজ কল স্থাপন করা। ১৮০১-১৮৩২ সালের মধ্যে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ৪০টি ভাষায় মোট ২,১২,০০০ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সকল উন্নয়নে শ্রীরামপুরের স্থানীয় জনসাধারণ প্রায়শই নিষ্কিয় ভূমিকা পালন করতেন। মিশনারিদের জনশিক্ষা বিস্তার, প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্ম বা সমাজ সংস্কারমূলক যেকোন ধরনের কাজে শ্রীরামপুরের অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর”)
কেরী কেন প্রথম ছিলেন? যখন বঙ্গের অধিকাংশ ধর্মীয় প্রচারক সংস্কৃত ও আরবী ভাষার গুণগান গাইতেন, এই কিতাবুল মোকাদ্দসের মূল হিব্রু ও গ্রীক ভাষার বিশেষজ্ঞ তার সমস্ত জীবন ব্যয় করলেন বাংলা ভাষার উৎকর্ষে। একজন ধর্মপ্রচারক কেন এমন কাজ করতে পারতেন? ইংরেজ কোম্পানির সহায়তা বা সমর্থন পাওয়ার জন্য তিনি প্রথম ছিলেন না। আমরা এর মধ্যে দেখতে পেরেছি যে ইংরেজ কোম্পানি কেরীর কাজের বিরুদ্ধে দাঁরালো এবং বারবার তা বন্ধ করতে চেষ্টা করতেন কারণ তারা ভয় করতেন যে গনশিক্ষা ও অক্ষরতার ফলে তাদের আর্থিক স্বার্থ বা কার্যক্রমের ক্ষতি হতে পারে।
কেহ বলতে পারে যে কেরীর কাছে বেশি অর্থসম্পদ থাকার কারণে তিনি এসব প্রথম করতে পেরেছেন। কিন্তু তা নয়: “এই মিশন ছিল স্বনির্ভরশীল। মার্শম্যান বিদ্যালয় থেকে, ওয়ার্ড প্রেস থেকে এবং কেরী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এ অধ্যাপনা করে নিজেদের ভরণপোষণ ও মিশনের কাজ চালাতেন।” (বাংলাপিডিয়া, “শ্রীরামপুর মিশন”)।
আসলে কেরী কলকাতার অন্যান্য বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ পরিবারের চেয়ে গরিব ছিলেন। আগে যেভাবে উদৃতি করা আছে, কেরীর দল তাদের নিজ শ্রমের শেষ পয়সা ব্যয় করেছেন অক্ষরতার উদ্যোগে। সেই সময়ে কলকাতায় অনেক বিলেতি-শিক্ষাসম্পন্ন ভদ্রলোক ছিল যারা বাংলা ভাষার জন্য কোন উদ্যোগ নেয় নি।
কেরীর অপূর্ব উদ্যোগের বাকি একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে যে তিনি মাতৃভাষা সম্মান দেওয়ার একটি অন্যন্য চিন্তাধারা পালন করতেন – ঈসা মসীহের শিক্ষার অনুসারে। ঈসার অনুসরণ করে কেরীর একটি লক্ষণীয় দর্শন ছিল প্রত্যেকটি জাতি আল্লাহ্র পবিত্র কালাম নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়ে এবং এবাদত করার সুযোগ দিতে। তিনি জানতেন যে জনগণের মুক্তি কোন অজানা ভাষায় শাস্ত্র মন্ত্রের মত সঠিক উচ্চারণ করার মাধ্যমে আসবে না বরং আল্লাহ্র চিরন্তন কালামের অর্থ বুঝা এবং তার অনুসারে আমাদের চিন্তা ও চরিত্র গঠন করা। যদিও তিনি শিক্ষায়, কৃষিবিজ্ঞান, উদ্যানবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনেক বিরাট ভূমিকা পালন করেন, তিনি সবসময় জানতেন যে জনগণের মুক্তি আনার প্রথম কাজ ছিল আল্লাহ্র কালাম তাদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করা।
কেরী বঙ্গদেশে যা করেছেন তা পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এমনভাবে হয়েছে। ইয়েল্ বিশ্ববিদ্যালয়ের লামিন সান্নেহ্ নামক একজন সম্মানিত আফ্রিকান ইতিহাসের অধ্যাপক তার ঞৎধহংষধঃরহম ঃযব গবংংধমব বইয়েতে দেখিয়েছে যে উপনিবেশিত জাতিদের মাতৃভাষা শক্তিশালী করে তলার প্রধান উৎস হচ্ছে কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ। ঈসা মসীহের হাজার হাজার অনুসারী কিতাবের মূল গ্রীক ও হিব্রু ভাষার পান্ডুলিপি থেকে প্রায় সমন্ড ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষদের আল্লাহ্র পবিত্র কালাম বোঝানো যাতে তারা নিজেকে অন্ধকার থেক মুক্ত পেয়ে আল্লাহ্র কাছে যেতে পারে। এই অধিকাংশ ভাষা হল পরিভূত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা বিদেশী শাসনের অধীনে ছিল। কেরীর দলের মত তারা সাধারনত বিপক্ষতা এবং বিরোধিতা পেত উপনিবেশি নেতাদের কাছে যারা এদের কার্যক্রমের ফল ভয় করত। যখন এইভাবে কিতাবের অনুবাদ হয়, একটি বর্ণমালা আবিষ্কার হয় এবং সাধারন মানুষ নিজ ভাষায় লেখাপড়া শেখে, তারা ক্ষমতা পায় মিক্তি পেয়ে নিজেকে নিজ ভাষায় নিয়ন্ত্রন করতে।
এখন শত বছরের বিদেশী ভাষার কর্তৃত্বের পর, আমাদের পিতারা সর্বশেষে বিদেশী ভাষার প্রশাসন তাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু নিজেকে আবার জিজ্ঞাসা করতে হবে; আমরা কি তাদের সেই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ-উৎসর্গের সম্মান দিচ্ছি যদি আমরা মনে করি যে বাংলা ভাষা এবাদত এবং কিতাব পড়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য? মাতৃভাষার সম্পর্কে আল্লাহ্র চিন্তা কি? বাংলা ভাষা কি শুধু একটি নিম্ন ভাঙ্গা ভাষা যেটা এবাদতে অযোগ্য? না কি সমস্ত জাতির অন্তরের ভাষা আল্লাহ্র চোখে সমান এবং এবাদতে সমানভাবে যোগ্য? আমার আশায় এই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাকে মাতৃভাষা সম্মান ও উৎকর্ষ করার উৎসাহ দিয়েছেন। * ***
অনেকের চিন্তার বিপরীতে কেরীর মত খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক বা মিশনেরিরা ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিল না। পক্ষান্তরে, ইংরেজ সাম্রাজ্যের সরকার এদের বিরুদ্ধে ছিল। কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইন্ডিয়া থেক অনেক টাকা অর্জন করা, এবং এদের এই কার্যক্রম সামরিক শক্তি দিয়ে রক্ষা করা। কোম্পানির কর্মকর্তারা ছিলেন বিলাসী উচ্চশ্রেণীর ইংরেজ, এবং কেরীর মত নিম্নশ্রেণীর গরিব ঈসায়ী প্রচারকদের তারা সহ্য করতেন না। প্রথম ইন্ডিয়াতে এসে কেরী এবং তার দু’জন সহকর্মীরা কলকাতায় তাঁদের কার্যক্রম চালাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু: মিশনবিরোধী ইংরেজ সরকারের বিতাড়ন এড়াতে মিশনারিরা দিনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। (বাংলাপিডিয়া, “শ্রিরামপুর মিশন”)।