বাআ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত এবং কানাডার আদালতে মামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির ভ্রান্ত অভিযোগে যাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল বিশ্ব ব্যাংক সে সব ক্ষতিগ্রস্তরা এজন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারে।’ গত শুক্রবার বিকেলে মিউনিখ ম্যারিয়ট হোটেলে ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ প্রবাসী আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের দাবির প্রেক্ষিতে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, কেননা পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ প্রত্যাহারের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বিচার পেল।…তারা আমার ছেলে এবং মেয়ে, বোন, আমার মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা, সচিবদের এই অভিযোগের সঙ্গে জড়াতে চেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাই হোক আমি বলব, সত্য এবং ন্যায়ের পথে এবং সৎসাহস থাকলেই কেবল কোন একজন মানুষ এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। কানাডার আদালতের রায় আমাদের অনুকূলে এসেছে, কারণ আমরা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মারকেলের আমন্ত্র্রণে ৫৩ তম নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল সকালে মিউনিখ পৌঁছেন। প্রধানমন্ত্রী এদিন, পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু টাকা ছাড়ের পূর্বে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে অর্থ প্রত্যাহারের নেপথ্যে বাংলাদেশের শান্তিতে নোবেল বিজেতা ড. ইউনুস এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক ফাস্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের জড়িত থাকার ইঙ্গিত করেন। এছাড়া আদালতে অর্থ আত্মসাতের মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে বেগম জিয়াকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি সত্যিই কোর্টের কাছে এভিডেন্স থাকে চুরি (এতিমের টাকা) করেছে, তাহলে তার শাস্তি হবে।’ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের টাকা আত্মাসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলা দুটি চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, ইউওরোপিয় আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাসগুপ্ত এবং সাধারণ সম্পাদক এম এ গনী, জার্মানী আওয়ামী লীগ সভাপতি বশিরুল আলম সাবু, প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিস ফরাজী, হাসান ইকবাল এবং নুরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে জার্মানি ছাড়াও ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন ও নরওয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন প্রকার দুর্ণীতি হয়ে থাকলে প্রমাণ করার জন্য বিশ্ব ব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরও সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বিশ্ব ব্যাংক অর্থ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রভাবশালী এবং নোবেল বিজয়ী ড. মো. ইউনুস তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে পর্যন্ত এই মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংক একটি বড়ো সংস্থা, কাজেই কেউ কেউ বিশ্বাসও করতে শুরু করেন যে, হয়তো তাদের অভিযোগের সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তুু বিশ্ব ব্যাংক তাদের এই অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যদি দুর্ণীতিই করতাম তাহলে বিশ্ব ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারতাম না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, সহকারি সচিব ব্লেইক এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন পর্যন্ত তাঁকে হুমকি দেন যে, ড. ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হলে বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করা হবে।
এমনকি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টর পক্ষ থেকে তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়কে তিনবার ডেকে পাঠিয়ে ড.ইউনুসকে যেন সরানো না হয় সেজন্য তাঁকে চাপ প্রয়োগ করা হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেন একজন নোবেল বিজেতার ব্যাংকের একটি এমডি’ পদ আঁকড়ে থাকার মোহ থাকবে।’
তিনি বলেন, আমরা তাকে (ড.ইউনুস) প্রস্তাব করেছিলাম ব্যাংকটির এমিরেটাস উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত থাকার জন্য। কিন্তুু, ড.ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংকের স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে লবিং করেন। জনগণের অর্থ আত্মসাতের জন্য তার সরকার ক্ষমতায় আসেনি বরং জনগণের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কানাডার আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে এই সত্যটিই যেন আবারও প্রতিভাত হলো।
একটি স্বার্থান্বেষী মহলের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের বিএনপি এবং তাদের সহযোগী জামায়াত-যুদ্ধাপরাধী গংদের যেকোন প্রকার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহবান জানান। নিরাপত্তা সম্মেলনে তার যোগদানের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আজকে বাংলাদেশও জঙ্গিবাদ এবং উগ্রচরমপন্থার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে যে, এই সমাজিক ব্যাধী দূর করতে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপই সে গ্রহণ করবে।
তার পরিবার সন্ত্রাসের অন্যতম স্বীকার এবং তিনি নিজেও উপুর্যপুরী কয়েকবারের প্রাণঘাতী হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কোন রাজনৈতিক দল তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে রাজনীতির নামে সন্ত্রাসকে ব্যবহার করছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩, ১৪ এবং ১৫ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানুষ হত্যার প্রসংগ উল্লেখ করেন।
২০১৩, ১৪ এবং ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের সীমাহীন সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের সঙ্গে কেবল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতারই তুলনা চলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা মসজিদ, মন্দির, বাড়ি-ঘর, স্কুল এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনটিকেই রেহাই দেয়নি। ‘নিরীহ মানুষ হত্যা কোন দলের রাজনীতি হত পারে না। তাদের রাজনীতিতে সাধারণের কোন অংশগ্রহণ ছিল না, যেকারণে তাদের আন্দোলনও সফল হয়নি’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সে সময় সরকার গঠনের দেড় মাসের মধ্যে বেগম জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। কারণ সে সময় জনগণই সেটা চেয়েছিল। আর অন্যদিকে ২০১৫ সালে বিএনপি’র বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ ক্ষেপে উঠেছিল, কারণ বিএনপি’র নির্মম রাজনীতির শিকার হচ্ছিল তারা। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে বলে বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ নয় বরং এতিমের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে।
সরকার প্রধান বলেন, ‘মামলা যদি মিথ্যাই হবে, তাহলে খালেদা জিয়া আদালতে যেতে ভয় পাচ্ছেন কেন।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ২০০১-২০০৬ সরকারের মেয়াদে অন্তত ডজন খানেক মিথ্যা মামলা করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তো প্রতিটি মামলা আদালতে মোকাবেলা করেছেন, তিনি তো ভয় পাননি। কারণ তিনি জানতেন, এসবই মিথ্যা এবং তা প্রমাণের সৎসাহস তার ছিল। ‘অন্যদিকে মামলার শুনানী বার বার পিছিয়ে দেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করছেন বেগম জিয়া’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।