বাআ॥ গার্মেন্টস কারখানা সংস্কারে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে পোশাকে বৈচিত্র আনার পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজতেও শিল্প মালিকদের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। গত শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দ্বিতীয় ঢাকা অ্যাপারেল সামিট ২০১৭’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাগণ সহায়তা করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্যসামগ্রীর চাহিদা কিভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
২০১৪ সালের প্রথম অ্যাপারেল সামিটের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) দিনভর এই দ্বিতীয় অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে। ২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনে কর্মপন্থা প্রণয়ন এবং তৈরি পোশাক খাতকে একটি টেকসই উন্নয়ন খাত হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ’টুগেদার এ বেটার টুমরো।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী মুজিবুল হক এবং বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়েদুন। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্রগতি নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং তৈরি পোশাক খাতের দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পোশাক শিল্পকে নিরাপদ রাখার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। গৃহীত উদ্যোগের আওতায় ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৮৬৯টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৯টি কারখানায় ত্রুটি পাওয়া গেছে এবং সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিএমইএ, সরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, উন্নয়ন সহযোগী সবাই মিলে একটি নিরাপদ ও টেকসই শিল্প গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি। পুরাতন বাজারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে শিল্পোদ্যোক্তাদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে রপ্তানি বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে পণ্যের বৈচিত্র এবং পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে।’
আমাদের রপ্তানি মূলত উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশনির্ভর। রপ্তানির ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি ভালো না। আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকা বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন দেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি রপ্তানিকারকদের আরো মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা এগিয়ে আসুন, সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পোশাকশিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এ খাতে। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটিরও বেশি মানুষ এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, পোশাকশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ, বিশেষ করে এর আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে বিজিএমইএ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পাশাপাশি আমার সরকারও প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা এবং প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী আমরা বিজিএমইএ’কে সি.ও ইস্যু করার ক্ষমতা প্রদান করেছি। পোশাকশিল্পের স্বার্থে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য পোশাকশিল্প সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর থেকে পোশাকশিল্পের স্বার্থে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। যার মধ্যে রয়েছে এ শিল্পে অগ্রিম আয়কর ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৭ শূন্য শতাংশ করা এবং তৈরি পোশাকশিল্পে কর্পোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং-এর কাঁচামাল ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার শ্রমিক-মালিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, শ্রমিকদের আইনগত অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং শ্রম কল্যাণে বহুবিধ কর্মসূচি যেমন- শ্রমকল্যাণ ফাউন্ডেশন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরণ, ন্যূনতম মজুরি কমিশন শক্তিশালী করা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান, শ্রম আইন সংশোধন এবং শ্রম বিধিমালা জারির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ পোশাক শিল্প এলাকায় নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ গঠনের পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যাতে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব জমিতে ডরমিটরি স্থাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ২টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিজিএমইএ’কে দেয়া হবে। ৪-লেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৬-লেনে উন্নীত করার বিষয়টিও আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।