বাআ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পুননির্বাচিত করতে জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের মধ্যে যে নির্বাচন অনুুষ্ঠিত হবে, আপনারা যদি এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান তাহলে সেই নির্বাচনে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে দেবেন। যাতে করে আমরা পুনরায় আপনাদের সেবা করার সুযোগ পাই।’
প্রধানমন্ত্রী রোববার বগুড়া জেলার আদমদিঘীতে শান্তাহার স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এই আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ আবারো পিছিয়ে যেতে পারে- আশংকা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলবো, নৌকা যখন ক্ষমতায় আসে তখন বাংলাদেশের মানুষ কিছু পায়। আর ধানের শীষ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ধানে চিটা ধরে যায় এবং দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। দেশে লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়। আদমদিঘী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনসার আলী মৃধার সভাপতিত্বে জনসভায় সভায় আরো বক্তৃতা করেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মামুদ স্বপন, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন, আব্দুল মান্নান, এমপি, হাবিবুর রহমান, এমপি, শহীদুজ্জামান সরকার, এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শান্তাহারে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)’র সহযোগিতায় প্রায় ২৩২ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫ হাজার মে.ট. খাদ্যশস্য ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন সম্পূর্ণ সৌরশক্তি চালিত ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি অত্যাধৃুনিক মাল্টিস্টোরিড ওয়্যারহাউজ (সাইলো) উদ্বোধন করেন। বিভিন্ন উন্নয়নকাজের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য তিনি বগুড়া পৌঁছেন। এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী এদিন বগুড়ায় ২শ’ ৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পগুলো হচ্ছে- নন্দিগ্রাম উপজেলা কমপ্লেক্সের সম্প্রসারিত ভবন ও হলরুম; শাহজাহানপুর থানা ভবন, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম ভবন, শাহজাহানপুর; শিবগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, সোনাতলা উপজেলার সিচারপাড়া-৩ গুচ্ছগ্রাম, সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি আশ্রয়ন প্রকল্প, আদমদিঘী উপজেলায় সোলার প্যানেলযুক্ত পাতকুয়ার মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম, জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস ভবন এবং বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়নে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।
প্রধানমন্ত্রী ৫২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ৭টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্থরও স্থাপন করেন। প্রকল্পগুলো হচ্ছে-সারিয়াকান্দি মহাসড়কে খৈলসাকুড়ি সেতু, বগুড়া-সারিয়াকান্দি মহাসড়কে জয়ভোগা সেতু, বগুড়া-সারিয়াকান্দি মহাসড়কে হাটফুলবাড়ী সেতু, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে সোনাতলা উপজেলায় ১০ কি. মি. রাস্তা; কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে সারিয়াকান্দি উপজেলায় ১০ কি.মি রাস্তা, বগুড়া প্রেসক্লাব ভবন এবং সোনাতলা উপজেলা পরিষদের সম্প্রসারিত প্রশাসনিক ভবন ও হলরুম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে, প্রত্যেক উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত রাস্তাঘাট করার জন্য ইতোধ্যেই এলজিইডি থেকে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে একনেকে পাশ করে দিয়েছি। শিগগিরই যার কাজ শুরু হয়ে যাবে। আমরা সমগ্র বাংলাদেশ ম্যাপ করে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি। যার ছোঁয়া আপনারা পাচ্ছেন, আপনারা পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘পিতা-মাতা, ভাই সব হারিয়েছি। আমার আর হারাবার কিছু নেই। শুধু আপনাদের জন্য আমরা কাজ করি এবং আপনাদের মাঝে আমার হারানো পিতা-মাতা এবং ভাইয়ের স্নেহ আমি খুঁজে পাই। কাজেই আজকে আপনাদের জন্যই সমস্ত কিছু ত্যাগ করে কাজ করে যাচ্ছি। আপনাদের কাছে আমার এটাই আবেদন- আগামী নির্বাচনে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে সেবা করার সুযোগ দেবেন। সেটাই আমি আশা করি।’
প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করায় বগুড়া এবং বিশেষ করে আদমদিঘীবাসীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আজকের যে দারিদ্রের হার যা বিএনপি’র আমলে ছিল ৪৭ ভাগ আমরা যাকে ২২ভাগে নামিয়ে এনেছি, আমাদের লক্ষ্য তা ১৫ ভাগে কমিয়ে আনা। প্রত্যেকটি গৃহহারা নদী ভাঙ্গা মানুষ ঘর পাবে, আশ্রয়নের মাধ্যমে আদর্শ গ্রাম ও গুচ্ছগ্রামের মাধ্যমে গৃহহীনকে ঘর করে দেয়া হচ্ছে, প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে বিনা পয়সায় বই দেয় হচ্ছে, যদি আপনারা চান- এটা অব্যাহত থাকুক, যদি আপনারা কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা অব্যাহতভাবে পেতে চান, ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া অব্যাহত রাখতে চান তাহলে আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন- বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম ও যুব সমাজকে খেলাধূলার সুযোগ করে দেয় হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছি, ইতোমধ্যে প্রায় সব উপজেলায় জমি দেখা হয়ে গেছে-সেই স্টেডিয়ামে ছেলে-মেয়েরা খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক চর্চা করবে, উন্নত জীবন পাবে সে ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, কেউ বেকার থাকবে না সেজন্য প্রশিক্ষণ দেয় হচ্ছে। সারাদেশে ৫২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে বহুলোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেখানে একজন ছেলে এবং একজন উদ্যোক্তা রাখা হয়েছে। আপনারা গ্রামে বসেই যেন বিদেশ থেকে আউটসোর্সিয়ের মাধ্যমে টাকা রোজগার করতে পারেন সেজন্য ‘ লার্নিং এন্ড আর্নিং’ এর প্রশিক্ষণ দেয় হচ্ছে। যাতে একটু উদ্যোক্তা হলে তারা নিজেরাই ব্যবসা-বণিজ্য করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পারবে।
সরকার প্রধান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ কেবল ঘোষণা নয় প্রতিটি জায়গায় আপনারা ইন্টারনেট সার্ভিস পাচ্ছেন, প্রতিটি জায়গায় আপনারা সেবা পাচ্ছেন। ঘরে বসে আজকে বিশ্বকে জানতে পারছেন, প্রবাসীদের দেখতে পাচ্ছেন, জিনিষ পত্র ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেন- আমরা সেই সুযোগ করে দিচ্ছি। আজকে আপনাদের সকলের হাতে যে মোবাইল ফোন সেটিও আওয়ামী লীগ সরকারেরই অবদান, বলেন প্রধানন্ত্রী। শেখ হাসিনা সারাদেশে একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য বগুড়াতেও জায়গা দেখা হচ্ছে। অন্যান্য বড় জেলাগুলোতে এবং ছোট জেলার দুই-তিনটা জেলা মিলে একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন শিল্প হবে। সেখানে মানুষের যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিক স্বচ্ছলতাও আসবে। সেইভাবেই বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তুু এগুলো যদি বাস্তবায়ন করতে হয়- তাহলে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। ঐ লুটেরা, সন্ত্রাসি, জঙ্গিবাদি, অবৈধবাবে ক্ষমতা দখলকারি ঐ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে এদেশের কোন উন্নয়ন হবে না। সবই থেমে যাবে, তারা নিজেরাই খাবে। কাউকে দেবে না।
‘আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা মানে সবাইকেই দেবে, সকলের জন্য উন্নয়ন হবে, প্রত্যেকের জীবন সুন্দর ও উন্নত হবে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই নৌকায় ভোট দিয়েই এদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। এই নৌকাতেই যখন ভোট দিয়েছে তখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, এই নৌকাতে ভোট দেয়াতেই আজকে মানুষের জীবনে স্বচ্ছলতা এসেছে। আজকে নৌকায় ভোটি দেয়ার জন্যই মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে। কাজেই আগামী দিনেও আপনাদের কাছে আমার এই আবেদন-আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের সামগ্রিক আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের পরিসংখ্যান তুলে বলেন, তাঁর সরকার কোন একটি বিশেষ এলাকার নয় সমগ্র দেশের উন্নয়নেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। যদিও বেগম জিয়া তার শাসনামলে গোপালগঞ্জকে উন্নয়নের ধারা থেকে বাদ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আল্লাহই বলেছেন- নিয়ত গুণেই বরকত, যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় দেশের উন্নতি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি কি পেলাম কি পেলাম না। তার চিন্তা করি না। আমার শুধু চিন্তা কিভাবে দেশের মানুষ ভাল থাকেবে, পেট ভরে খেতে পারবে, উন্নত জীবন পাবে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত করা।’ এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার জন্য বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করে তাদের শাসনামলে দেশে সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ’৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের চাইতে বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বিএনপি শাসনামলে হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, চেয়ারপার্সনের দু’পুত্রের অর্থ পাচারসহ বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে এদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সাবধান থাকারও আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সন্ত্রাস ও জাঙ্গিবাদ প্রশ্নে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করে শিক্ষক, অভিভাবক, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিদমনের উদ্যোগে সকলকে সম্পৃক্ত হবার আহবান জানান। নিজ নিজ পুত্র-পোষ্য যেন কোনভাবেই এপথে যেতে না পারে সেজন্য ও সকলকে সতর্ক করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী খেলাধূলাসহ সাংস্কৃতিক চর্চায় বেশি করে মনোনিবেশ করার জন্য তরুণ ও যুব সমাজের প্রতি আহবান জানান।