তোফায়েল আহমেদ॥ বছর ঘুরে ৭ মার্চ এলেই মনে পড়ে ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। কীভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ধাপে ধাপে তিনি একত্রিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ, এমন একটি দিনের জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজেকে, আওয়ামী লীগকে সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালি জাতিকে উন্নীত করেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। দলের সামান্য একজন কর্মী হিসেবে আমার ঠাঁই হয়েছিল তার নৈকট্য লাভের। খুব কাছ থেকে এই মহান নেতাকে যতটা দেখেছি তাতে কেবলই মনে হয়েছে, আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের কত কিছু শেখার আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে। তিনি তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগ দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজ পরিবারের মতো। শ্রেণী নির্বিশেষে দলীয় প্রত্যেক নেতাকর্মীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সবার প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা, অকুণ্ঠ ভালোবাসা। সবাই তার প্রতি স্থাপন করেছিল গভীর বিশ্বাস। বিশেষ করে দলের কর্মীদের তিনি আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তাদের দুঃখ-কষ্টে, বিপদ-আপদে সহমর্মী হতেন। শুধু তাই নয়, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পর্যন্ত বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতেন। কখনও কারও মনে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলতেন না। অহংকার আর দাম্ভিকতা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল- সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন তিনি বুঝতেন, তেমনি কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন, তাকে সেই জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না মোটেই। ’৭১-এ তার অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানের গুরুভার অর্পণ করেছিলেন জাতীয় চার নেতাকে এবং তারা সে দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি, অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনাকালে সব সময় পাশে রাখতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে। সবাইকে সম্মানিত করতেন বলেই বাংলার সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়ে হয়েছেন ‘জাতির জনক’। বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় যেমন স্থান পেয়েছেন, তেমনি জনসাধারণও তার চেতনায় ছিল দেদীপ্যমান। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে পিতা-মাতার পাশেই শায়িত বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি মনে পড়ে- চেতনায় সততই বিরাজ করে।
স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর। ’৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারা দেশ। দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে চারদিকে। বিশেষ করে ঢাকার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় পল্টন ময়দান। বিকাল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিবাদ সভায় জনসাধারণকে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রক্তঝরা প্রতিটি দিনের কর্মসূচি নির্ধারণ হতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তার নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনি বা করদ রাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর ভেঙে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকিত হয়েছিল এই স্লোগানে- ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠ একই সুরে বেঁধে দিয়েছিল। সবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে ‘জয় বাংলা’। দিনটি ছিল রোববার। সকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী দুপুর ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রেসকোর্স ময়দানে তখন মুক্তিকামী মানুষের ঢল। আকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা, আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। চারদিকে লক্ষ মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা’। কার্যত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ছিল বাঙালির রণধ্বনি। বীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন।
রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরুষ-নারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক-জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছি, তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোনো লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। মানুষ গাছের উপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সেই জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্র নির্ঘোষে তুমুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তার চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোময় কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তার সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। এমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী অপরিসীম আস্থা তার প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি; তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না!’ এমনকি জীবনের চেয়েও প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, তাও তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে চারটি শর্তের বেড়াজালে বাঁধলেন শাসকের চক্রান্তকে এবং সামরিক শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। একদিকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেন, ‘সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; এবং গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।’ রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ, বোমা হামলার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। যার জন্য পরের দিন পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গেই বক্তৃতা করে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, অপরদিকে চারটি শর্ত আরোপ করে পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিলেন না।’
রেসকোর্স ময়দানে প্রাণের টানে বাংলার মানুষ বারবার ছুটে আসে। এর আগেও এসেছিল ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে, বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়ে ৩৩ মাস কারাবন্দি থেকে এক অপূর্ব ধৈর্য ও নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মোকাবেলা করেন। বাঙালি সেদিন তার মুক্তির জন্য রাজপথে স্লোগান তুলেছিল, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মা-গো তোমায় মুক্ত করব।’ এবং মুক্তমানব শেখ মুজিবকে মুক্ত করে বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই সেই রেসকোর্স ময়দান যেখানে বাংলার মানুষ শুনেছে এক ইউনিট আর প্যারিটির মৃত্যুঘণ্টা; ’৭০-এর ৭ জুন শুনেছে ৬ দফার জয়নিনাদ; আর ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি শুনেছে ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অগ্নিশপথ। আর ৭ মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘমন্ত্র। সেদিন রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন, ‘ভায়েরা আমার’ বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘…প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ বীর বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ পালন করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছিল।
১,১০৮টি শব্দসংবলিত প্রায় ১৮ মিনিটের এ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা আর চরম আত্মত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তার কণ্ঠ কাঁপেনি-থামেনি, গণশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুংকারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরদেশে যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিচক্ষণ নেতা। তিনি অত্যন্ত ভেবেচিন্তে কথা বলতেন। ৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনটির জন্যই তিনি সারা জীবন অপেক্ষা করেছেন। মূলত এদিনেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ‘সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে তিনি কী বলবেন তাই নিয়ে ৬ মার্চ সারা রাত তিনি ভেবেছেন।’ বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যে, তিনি অন্তরের গভীরে যা বিশ্বাস করতেন বক্তৃতায় তা-ই ব্যক্ত করতেন। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ হৃদয়ে ধারণ করে সংগ্রামী জনতার দীপ্ত স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়।
বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য স্থির করে কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন। যেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি; একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। আর তাই তিনি ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য। ’৭০-এ স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফও’র অধীনে নির্বাচন করে জয়যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছেন আপামর বাঙালির তিনিই অবিসংবাদিত নেতা, বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি- যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে ৩০ লক্ষাধিক শহীদের কথা স্পষ্টাক্ষরেই লেখা আছে। অথচ বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যখন সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন, তখন ঘৃণা প্রকাশ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এ ধরনের বক্তব্যেই উৎসাহিত হয়েছে পাকিস্তানিরা। আজ তারা ৩০ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করব।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দুটি। একটি বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। অপরটি স্বাধীন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। প্রথম স্বপ্নটি তিনি পূরণ করে গেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়যুক্ত হয়ে আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা, ‘শহীদের রক্তে লেখা’ পবিত্র সংবিধান, গৌরবময় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। যে জন্য দ্বিতীয় যে স্বপ্ন অর্থাৎ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার কাজটি বঙ্গবন্ধু করে যেতে পারেননি। আজ জাতির জনকের দ্বিতীয় স্বপ্নটি পূরণ করার পথে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন তার নেতৃত্বেই স্বাধীন বাংলাদেশ হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।