ডা: দীপন॥ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগ বিষয়ে সচেতন নয়। থ্যালাসেমিয়া রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করতে হলে দরকার ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরা অভিমত পোষণ করেন, যেহেতু থ্যালাসেমিয়ার তেমন চিকিৎসা আামদের হাতে নেই, অতএব, এ রোগ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া আছে কি-না তাও পরীক্ষা করে দেখা উচিত। গর্ভের শিশুর (চার মাসের পর থেকে) থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা আজকাল এদেশেও নির্ণয় করা সম্ভব। অবশ্য, আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের পদ্ধতি এখনও সহজলভ্য নয় বলেই ধারণা লোকসমাজে প্রচলিত রয়েছে। তবে এটা সত্য যে, এই রোগ থেকে নিরাময়ের পরিপূর্ণ কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি নেই। এটি একটি ব্যয়বহুল রোগ। তাই, এই রোগ প্রতিরোধের পূর্ব সতর্কতাস্বরূপ বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর রক্তের হিমোগ্লোবিনের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে এ রোগের বাহক হলেই সন্তানের এ রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। বলা হয়, থ্যালাসেমিয়ার কোনোরূপ সম্ভাবনা আছে এমন পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে অন্য কোন থ্যালাসেমিয়া রোগী বা রোগের সম্ভাবনা আছে তেমন কারও বিয়ে হলে তাদের সন্তানরাও এই রোগে আক্রান্ত হবে। তাই, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার সতর্কতাই সুস্থ সন্তান ও সুস্থ জাতি তৈরি করার স্বার্থে জরুরী। আর, আজকের বাস্তবতায় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ বোন-মেরো পরীক্ষা, বোন-মেরো প্রতিস্থাপন ইত্যাদি ব্যয়বহুল চিকিৎসা যাতে এদেশের রোগীরা পেতে পারে তার জন্যে সরকারী উদ্যোগের আবশ্যকতা অনুভব করেছেন। একে দেশবাসীর সময়োচিত দাবী বলেই আমরা মনে করি। আমাদের বহু ক্ষেত্রের অপ্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় ব্যয় এবং অপচয় রোধ করেই জনগণকে এই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ তাদের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক বুনিয়াদ থাকা সত্ত্বেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দুর্বল অবস্থানের এই দেশে মানহীন স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোতে এ জাতীয় রোগীদের চিকিৎসা প্রাপ্তির মৌলিক অধিকার অবহেলিতই হয়। এ বিষয়ে জন-কল্যাণকামী সরকারেরই অনেক করণীয় রয়েছে বলে আমরা মনে করি। জানা থাকা উচিত, থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের ‘জিনঘটিত’ রোগ। এই রোগ হলে রক্তের লোহিতকণিকা ভেঙে যায় এবং রোগী রক্তস্বল্পতায় ভুগতে থাকে। রক্তের সম্পর্কের মধ্যকার বিবাহিতদের সন্তানদের মধ্যেই এই রোগটি বেশি হতে দেখা যায়। তাই, অতি নিকট আত্মীয় তথা রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে না করার কথা এ রোগ প্রতিরোধের জন্যেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বিশ্ব সংস্থার হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪.৮% (শতাংশ) মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছে। অর্থাৎ প্রায় ৭০ লাখ রোগী রয়েছে এদেশে যারা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এক বিলিয়ন থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে। আর প্রতিবছর ৩.৫ প্রায় মিলিয়ন নোতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে এই সংখ্যার সাথে। আমাদের দেশের মানুষের ধারণা খুব একটা পরিষ্কার নয় থেলাসেমিয়া রোগের বিষয়ে। বলা হচ্ছে, এটি একটি বংশগত ত্রুটি। রক্তের লোহিত কণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন, যা দেহের অক্সিজেন পরিবহনের প্রধান বাহন। হিমোগ্লোবিনে আলফা ও বিটা নামে দুটি গ্লোবিন (প্রোটিন) চেইন থাকে। থ্যালাসেমিয়াতে এ দুটি গ্লোবিন চেইনেই গ-গোল থাকতে পারে। যখন দুটিতেই থাকে, রোগের নাম হয় থ্যালাসেমিয়া মেজর। আর, একটি চেইনে অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে, তখন হয় থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এক্ষেত্রে রোগীর দৈহিক উপসর্গ কম থাকে। থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীর হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা খুব কমে যায়। তাতে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। আর অবশ্যম্ভাবী রূপে দেখা দেয় রক্তস্বল্পতা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্ত স্বল্পতাও বৃদ্ধি পায়। শিশু-রোগিরা কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে। স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মালেও দিন দিন ওজন কমে যায়। রোগীর ক্ষুধা কম থাকে। কিছুকালের মধ্যে রোগাক্রান্ত শিশুর মাথা ও মুখম-ল বৃহদাকৃতির হয়ে একটি বিশেষ ধরনের চেহারার রূপ নেয়। এই ধরনের চেহারাকে বলে ‘থ্যালাসেমিয়া ফেস’। এই রোগে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে যকৃৎ ও ফুসফুস অন্যতম। থ্যালাসেমিয়া রোগীর দেহে প্রতিনিয়ত যে রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাইরে থেকে রক্ত দিয়ে তার প্রতিস্থাপনের চেষ্টাই করা হয় শুধু। কিছু কিছু রোগীর বোন-মেরো প্রতিস্থাপন করে ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে, বারবার রক্ত দিয়ে কোনো রোগীকেই পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় না। প্রথম প্রথম তিন মাস অন্তর এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। পরে দেখা যায়, দু’মাস অন্তর রক্ত দিতে হচ্ছে। বয়স্ক থ্যালাসেমিয়া রোগীদের কারও কারও এক মাসের মধ্যেই একাধিকবার রক্ত দেবার প্রয়োজন দেখা দেয়। এইসব প্রক্রিয়ার সাথে প্রচুর অর্থ খরচ তো আছেই ভোগান্তির চরম হয় যদি কারও রক্ত দুর্লভ গ্রুপের হয়ে পড়ে। এই রোগটি ক্রমান্বয়ে এই দরিদ্র দেশে আমাদের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হতে থাকায় মানুষের অসচেতনতার বিষয়টিও প্রকট হয়ে উঠছে। দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে দীর্ঘকাল সম্ভবও হয় না রোগাক্রান্ত সন্তানের চিকিৎসার খরচ বহন করা। আবার চিকিৎসা যা আছে তা-ও পূর্ণ নিরাময়ের নিশ্চয়তা দেয় না। অতএব, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে জনসচেতনতারই কোনো বিকল্প নেই। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে তথা রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়েও পরিত্যাগের কথা আমাদের ভাবতে হবে। এই ধরনের রোগীদের পালক-সন্তান গ্রহণ করাই উচিত হবে।
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post