হাছান মাহমুদ মামুন॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই নিয়ে এখন সর্বত্র চলছে আলোচনা। ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার বেশি আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ এমওইউ সইয়ে সম্মতি দিয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই এমওইউ খসড়ায় প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতার পাশাপাশি এই শিল্পের বিকাশে যৌথ উদ্যোগ, মহাকাশ প্রযুক্তি, কারিগরি সহায়তা, অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে এক দেশ অন্য দেশকে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সীমারেখায় সমন্বিত টহলসহ যৌথ ও সমন্বিত অনুশীলন করবে দু’দেশ। এছাড়া উভয়পক্ষ আন্তর্জাতিক আইন, নিজ নিজ জাতীয় আইন, শর্তগুলো, নীতি এবং প্রথা মেনে নিজস্ব স্বাভাবিক কর্মকান্ড কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে সক্রিয়ভাবে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে কাজ করবে।
আগামী ৭-১০ এপ্রিল চার দিনের সফরে ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরে কোনো চুক্তি সই না হলেও প্রায় ৩৯টি সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে কাজ করছে দু’দেশ। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারকের খসড়ার কপি সকালের খবরের কাছে রয়েছে। তা থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হল :
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা :
এমওইউর অনুচ্ছেদ-২-এ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সামরিক সদস্যদের সফর বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, তথ্যবিনিময়, কর্মশালা আয়োজন, প্রশিক্ষণ, আলোচনা সভা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে অনুষ্ঠান এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক শিক্ষা সফরের কথা বলা হয়েছে। এসব সফরের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অসামরিক ব্যক্তিরাও সফরের জন্য মনোনীত হতে পারবেন। প্রকৃত যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী/নকশাকারী প্রতিষ্ঠানের যথাযথ অনুমতিসাপেক্ষে প্রয়োজনে সামরিক সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণে পরস্পর সহযোগিতা প্রদান করবে। সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে দু’দেশ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কর্মকান্ড নিয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে বলা হয়েছে-প্রশিক্ষণ, মতামত, সক্ষমতা বিনিময়, একে অন্যের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রহণ, প্রশিক্ষক বিনিময়, আলোচনা সভা, কর্মশালা এবং যৌথ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। দ্বিপক্ষীয় মতামতের ভিত্তিতে নিয়মিত ক্রীড়া এবং দুঃসাহসিক অভিযান কার্যক্রম আয়োজনের পাশাপাশি চিকিৎসা সহযোগিতার বিষয়টিও রাখা হয়েছে খসড়ায়।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে জাহাজ ও উড়োজাহাজের সফর বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সীমারেখায় সমন্বিত টহলসহ যৌথ ও সমন্বিত অনুশীলন করবে।
প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা : উভয়পক্ষ জাতীয় আইন অনুযায়ী যৌথ উদ্যোগ, মহাকাশ প্রযুক্তি সহযোগিতা, কারিগরি সহায়তা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা করবে। প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতাগুলো প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান এবং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে তাদের বাণিজ্যিক কার্যকারিতা, প্রতিযোগিতামূলক দর, গুণগত মান নিশ্চিতকরণ এবং পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে সংঘটিত হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো একটি পক্ষ তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত কোনো চুক্তিসীমা লঙ্ঘন করবে না। উভয়পক্ষ সরকারি নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা শিল্পে উন্নয়নে সহযোগিতার ধরন এবং প্রতিরক্ষা পণ্য উত্পাদনে সহযোগিতা করবে। এই সহযোগিতা উভয়পক্ষ নিজস্ব জাতীয় প্রয়োজনীয়তা এবং পারস্পরিক সম্মত শর্তাবলি অনুযায়ী করবে।
প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা সহযোগিতা : বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারকের খসড়া অনুযায়ী উভয়পক্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিষয়ক সহযোগিতা করবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলীদের সফর বিনিময় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তথ্যবিনিময় করবে।
সহযোগিতার ব্যবস্থাপনা : প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এমওইউর ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই সমঝোতা স্মারকটি পর্যবেক্ষণ, পরিচালনা এবং বাস্তবায়নে প্রতিরক্ষা সচিব এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পর্যায়ে বার্ষিক সংলাপ হবে। এই আলোচনা প্রতিবছর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ এবং ভারতে অনুষ্ঠিত হবে।
তথ্য নিরাপত্তা : খসড়ার ৭নং অনুচ্ছেদে বিনিময়কৃত তথ্যের নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় যেসব গোপন তথ্য বিনিময় হবে, সেগুলো যাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়, তা দু’পক্ষ নিশ্চিত করবে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রক্রিয়ার সময় দু’পক্ষ গোপনীয়তা মেনে চলবে। তৃতীয় কোনো পক্ষের স্বার্থ লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো পক্ষ নিজ সরকার কর্তৃক নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রদানকৃত সদস্য ছাড়া অন্য কারও কাছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় প্রাপ্ত গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এই অনুচ্ছেদের শর্তগুলো সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার পরও কার্যকর থাকবে।
সংশোধন ও সম্পূরক : উভয়পক্ষের লিখিত সম্মতিতে এই সমঝোতা স্মারকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক সংশোধন করা যাবে। এই সংশোধন বা সম্পূরক উভয়পক্ষের সম্মতির দিন থেকে প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে সংশোধন বা সম্পূরক কার্যকর হওয়ার দিন বা আগের সময়ে এই সমঝোতা স্মারককে কোনো পক্ষ প্রভাবিত করবে না।
বিরোধ নিষ্পত্তি : এই সমঝোতা স্মারকের কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করা হবে।
বৈধতা মেয়াদ এবং পরিসমাপ্তি : সমঝোতা স্মারকের ১১নং অনুচ্ছেদে মেয়াদ ও পরিসমাপ্তির কথা বলা হয়েছে। ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারকটি সইয়ের পর থেকে মেয়াদপূর্তির পর দিন নবায়ন হবে। যদি এটিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যেকোনো পক্ষকে নোটিস দিয়ে তা জানাতে হবে। সমঝোতা স্মারকের ৫ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে কোনো পক্ষ পরিসমাপ্তি করতে চাইলে অন্যপক্ষকে ৬ মাস আগে কূটনৈতিক মাধ্যমে লিখিত নোটিস দিতে হবে।