বাআ॥ ভারতের সঙ্গে চুক্তিস্বাক্ষর করে সরকার দেশ বিক্রি করে দিয়েছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলো জনগণ ও আঞ্চলিক কল্যাণে স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বলছেন ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে দেশ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তারা অর্বাচীন। কারণ আমরা সামগ্রিকভাবে জনগণ ও আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছি। তিনি গত সোমবার বিকেলে হোটেল তাজমহলে ব্যবসায়ীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বলেন, আপনারা বলুন, আমরা দেশ বেচে দিলাম নাকি কিছু অর্জন করে ফিরছি। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসি) এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করার জন্য ভারতের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি উদ্ভাবনী ও বাস্তবভিত্তিক অর্থনীতি বিনির্মাণ করা, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। আমি নিশ্চিত আমরা একত্রে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবনমানের পরিবর্তন আনতে পারবো।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল দেশ। এ দেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং একসাথে উন্নয়নের লক্ষ্য ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংরাদেশের চমৎকার সম্পর্ক। তিনি বলেন, আপনারা ধনী। এজন্য আমি বাংলাদেশে আপনাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ করার আহ্বান জানাই। ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বেশি মুনাফা সাশ্রয়ী ব্যয় ও বিপুল সংখ্যক ভোক্তার সুযোগ নিতে পারে। আপনাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় আমাদের রয়েছে ইন্দো-বাংলা বিনিয়োগ চুক্তি। এতে রয়েছে শতভাগ মুনাফা ও পুঁজি ফেরত নেয়ার আকর্ষণীয় প্যাকেজ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ইইউ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাসহ বিশ্বে ৩৮টি দেশ থেকে জিএসপি সুবিধা পায়। শেখ হাসিনা ভারতের ব্যবসায়ীদের বলেন, আপনারাও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও চিলির মতো দেশগুলো থেকে বাংলাদেশকে দেয়া শুল্ক মুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সুযোগ নিতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পায়ন ও বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ১শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। এর মধ্যে মংলা, ভেড়ামারা ও মীরসরাই বিশেষভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হাই টেক পার্ক গড়ে তুলছে এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কতৃর্পক্ষ (বিআইডিএ) গঠন করেছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ জোন কতৃর্পক্ষ (বিইপিজেডএ)ও গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য আরো সহজীকরণ করতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালুর বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের একটি অন্যতম দিক । বর্তমানে আমাদের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ হাজার ৭২৬ মেগাওয়াট এবং আমরা ২০২১ সাল নাগাদ ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছি। বাংলাদেশ এখন অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ করে পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বিনিয়োগ করছে বলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। তিনি ভারতের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বলানি খাতে, যন্ত্রাংশ তৈরি এবং সড়ক পরিবহন খাতে বিনিয়োগেও উৎসাহিত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে আমরা বড় রকমের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মধ্যদিয়ে সময় অতিবাহিত করছি। একইসঙ্গে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নতি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অর্জনের পথে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের ডিজিটাল দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পথে রয়েছি। ‘প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারস’ (পিডব্লিউসি) তার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘২০৫০ সালের বিশ্ব’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিক এক রিপোর্টে অনুমান করেছে-২০৩০ সালে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ এবং বাংলাদেশ হবে ২৯তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
বাংলাদেশ গেল অর্থবছরে ৭ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশাবাদি আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ হবে। বর্তমানেই আমাদের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৪শ’ ৬৬ ডলার। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের দেশে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে সক্ষম হয়েছি এবং আমাদের লক্ষ্য এই বিনিয়োগের পরিমাণ ২০২০ সাল নাগাদ অন্তত ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রপ্তানি খাতকে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ২০২০ সাল নাগাদ আমরা আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ৫৪ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি এবং ২০২১ সাল নাগাদ কেবল তথ্যপযুক্তি খাতেই ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য ধার্য করেছি।
‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ তাঁর সরকারের পররাষ্ট্র নীতি- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই তাঁর সরকার দেশকে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে চায়।
অনুষ্ঠানে অন্যানের্য মধ্যে- ভারতের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. ধর্মেন্দ্র প্রধান, ভারতের সাবেক চেম্বার প্রধান আদি গোদরেজ এবং বর্তমান চেম্বার সভাপতি স্বন্দীপ জাইওদিয়া, এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ এবং ভারতীয় ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সাবেক সভাপতি হর্ষ মরিয়ালা বক্তৃতা করেন।