ফেবুলি॥ “মাস্টারদা সবাইকে ডেকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে ছড়িয়ে পড়তে বললেন। আমি সহ আরো জন-দশেকের দায়িত্ব ছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনের আশপাশে রাত ১০ টার মধ্যে উপস্থিত থাকা। আমারা যথাসময়ে মিলিটারী পোশাক পরে উপস্থিত হলাম। সঙ্গে ছিল দুখানা শাবল, আলমারি ভাঙার জন্য। কথা ছিল রাত ১০টায় আরেক গ্রুপ পাহাড়ে উঠে প্রহরীদের আটক করবে এবং বন্দে মাতরম’ চিত্কার করবে।
এই চিত্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা জঙ্গলের চারদিকে ছিলাম তারাও একযোগে বন্দে মাতরম বলে চিত্কার করে পাহাড়ে পৌছাব। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছি। তখনো জানি না আমাদের মিশন কতটুকু সফল হবে। জীবনের প্রথম এ ধরনের একটি অপারেশন করছি। এমন সময় হঠাৎ করে ওপর থেকে বন্দে মাতরম চিত্কার শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা জঙ্গলে ছিলাম তারা একযোগে বন্দে মাতরম চিত্কার দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে পড়লাম। ব্রিটিশ রাজের পুলিশরা আমাদের চিত্কার শুনে ভাবল, আমরা হয়তো সংখ্যায় অনেক। ফলে তারা ভয়ে পালালো। পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকে শাবল দিয়ে আলমারি ভেঙে রাইফেল, বারুদ নিয়ে নিলাম। আর যা প্রয়োজন হবে না তাতে আগুন লাগিয়ে দিলাম।
সে দিন আমারা সবাই যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলাম বলেই পুলিশ লাইন আক্রমণ সফল হয়েছিল। আমাদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এসেছিল, যা পরে জালালাবাদ যুদ্ধে কাজে লাগানো হয়।” ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বিখ্যাত অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী।
৬৫ জন তরুন বিপ্লবী স্বদেশপ্রেম আর স্বাধীনতার স্বপ্নে সজ্জিত হয়ে একত্রিত হয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে। তাদের লক্ষ্য ছিলো চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করা। ১৬ বছর বয়সে এক দিন বিপ্লবী রামকৃষ্ণের সঙ্গে বিনোদবিহারীর পরিচয় হয়। সেখান থেকেই প্রকৃত বিপ্লবী জীবনের শুরু। এর দু-তিন মাসের মধ্যেই তিনি মধুসূদন দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদরের মতো আরো কয়েকজন বিপ্লবী নেতার সান্নিধ্যে আসেন। তখন মাস্টারদা সূর্যসেন জেলে। ১৯২৯ সালে প্রথম দেখা হয় মাস্টারদার সঙ্গে।
মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে প্রধান সহযোদ্ধারা ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার , কল্পনা দত্ত, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অর্ধেন্দু দস্তিদার (জালালাবাদ পাহাড়ের সশস্ত্র শহীদ), কালিপদ চক্রবর্তী, আম্বিকা চক্রবর্তী, মাখন ঘোষাল, তারাকিশোর দস্তিদার, নির্মল লালা প্রমূখ । বিনোদবিহারী ছিলেন সূর্যসেনের তরুন সহযোগী। মাত্র ১৯ বছরের তরুন বিনোদকে পড়াশুনার পরামর্শ দিয়ে সস্নেহে এড়িয়ে যান মাস্টারদা। কিন্তু বিনোদের চাপে এবং অন্য কোন দলে যোগদানের হুমকিতে হাসিমুখে বরণ করেন এই তরুন বিনোদকে। অল্প দিনেই বিনোদবিহারী চৌধুরী মাস্টারদা সূর্যসেনের স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠনে বিনোদবিহারী চৌধুরী তাই হতে পেরেছিলেন সূর্যসেনের অন্যতম তরুণ সহযোগী।
বিনোদবিহারী জানান- “১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটি গুলোর পতন ঘটিয়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নেতা-কর্মীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং মাস্টারদাকে প্রেসিডেন্ট ইন কাউন্সিল, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ বলে ঘোষণা করা হয় এবং রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে মাস্টারদা সূর্যসেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তুমুল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি ও আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে এ অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়।”
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসকের সব ঘাঁটির পতনের পর মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। মাস্টারদা সূর্যসেনকে রাষ্ট্রপতি পদে বরণ করে অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণাও দেন তিনি ও তার সঙ্গীরা। ব্রিটিশ ভারতে তিনদিনের জন্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন রেখেছিল বিপ্লবীদের দল। বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়াল খালী থানার উত্তরভুর্ষি গ্রামে। বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন পেশায় উকিল। অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী কামিনী কুমার বিলেতি কাপড় ছেড়ে খদ্দরের কাপড় পরা শুরু করেন, বিনোদ বিহারীকেও তাই পরতে দিতেন। ১১ বছর বয়সের বালক তখন থেকেই দীক্ষা পায় বিপ্লবের।
রায় বাহাদুর বৃত্তি পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯২৯ সালে। এর দুই বছর আগে ১৯২৭ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার মহান ব্রত নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এ। বন্দী থাকা অবস্থায় প্রথম শ্রেণীতে আই.এ এবং বি.এ পাশ করেন। সেই যে শুরু জীবনে চলার পথে, তা থেকে তাকে কেউ বিরত করতে পারেনি। কারো চোখরাঙানি যেমন তাকে টলাতে পারেনি আবার কোনো ধরনের স্বার্থের হাতছানি তাকে বিন্দুমাত্র আদর্শচ্যুত করতে সক্ষম হয়নি।
জালালাবাদ যুদ্ধ ছিল বিনোদবিহারী চৌধুরীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। সেদিন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অসীম সাহসিকতায়। গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েও লড়াই থামাননি। চোখের সামনে দেখেছিলেন ১২ জন সহকর্মীর মৃত্যু।
“আমরা দলে ছিলাম ৫৪ জন, পাহাড়ে লুকিয়ে আছি, তিন দিন কারো পেটে ভাত পড়েনি। পাহাড়ি গাছের দু-একটি আম খেয়ে দিন পার করেছি। এ কারণে বিপ্লবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই একদিন বিকেলে অম্বিকাদা কীভাবে যেন বড় এক হাঁড়ি খিচুড়ি নিয়ে হাজির হলেন। আমরা তো অবাক। ওইদিন সেই খিচুরি আমাদের কাছে মনে হয়েছিল অমৃত।”
“এর আগে অস্ত্রাগারে আগুন লাগাতে গিয়ে হিমাংশু সেন বলে এক বিপ্লবী অগ্নিদগ্ধ হয়। তাঁকে নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষ, আনন্দ গুপ্ত ও মাখন ঘোষাল দামপাড়া ত্যাগ করে। এ ঘটনার পর তত্কালীন চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমুদ্র বন্দরের বিদেশী জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সৈন্য নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে।
কিন্তু লোকনাথ বলের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী তার যোগ্য জবাব দিয়েছিল। এদিকে অনন্তদা ও গণেশদা হিমাংশুকে রেখে ফিরে না আসাতে মাস্টারদা অন্যান্যের সঙ্গে পরামর্শ করে দামপাড়া ছেড়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২১ এপ্রিল তারিখেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়াতে শেষ রাতের দিকে পুনরায় শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে আমরা ফতেয়াবাদ পাহাড় হতে রওনা হই। মাস্টারদা আমাদের ডেকে বললেন, আমরা যেকোন প্রকারেই আমাদের কর্মসূচি পালন করব। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ভোর রাতে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণ করা হবে। বিনোদবিহারী চৌধুরীরা ফতেয়াবাদ পাহাড় থেকে সময়মতো শহরে পৌঁছাতে পারলেন না। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁদের আশ্রয় নিতে হলো জালালাবাদ পাহাড়ে।
ঠিক করা হলো রাতের বেলা এখান থেকেই শহরে ব্রিটিশ সৈন্যদের অন্যান্য ঘাটি আক্রমণ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের, গরু-বাছুরের খোঁজে আসা রাখালরা মিলিটারি পোশাক পরিহিত বিপ্লবীদের দেখে পুলিশে খবর দেয়। ওই রাখালদের দেখেই সূর্যসেন প্রমাদ গুনেছিলেন। তখনই তিনি ধারণা করেন ব্রিটিশদের সংগে সংঘর্ষ অনিবার্য। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার আশংকা বাস্তব হলো। মাস্টারদা লোকনাথ বলকে আসন্ন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন।”
“লোকনাথদা যুদ্ধের একটি ছক তৈরি করেছিলেন। আমাদের কয়েকজনের দায়িত্ব ছিল ত্রিশাল আক্রমণের। যাতে ব্রিটিশ কোনক্রমে পাহাড়ে উঠে আসতে না পারে সেজন্য আমাদের যুদ্ধকৌশল কী হবে তা বলে দিলেন। বেলা ৪ টা নাগাদ পাহাড় থেকে দেখলাম সৈন্যবোঝাই একটি ট্রেন জালালাবাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে থামল। ডাবল মার্চ করে ব্রিটিশ সৈন্যরা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে দু’পক্ষের তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো।
ব্রিটিশ ফৌজ কিছুতেই পাহাড়ের ওপর উঠতে পারছিল না। তারা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। আর আমাদের তেমন কোনো অস্ত্রও ছিল না। এ ছিল এক অসমান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথম শহীদ হলেন হরিগোপাল বল নামে ১৫ বছরের এক বিপ্লবী। শহীদের রক্তে জালালাবাদ পাহাড় সিক্ত হলো। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম আরেক বিপ্লবী বিধু গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। মারা যাওয়ার আগে বিধু বলল, ‘নরেশ আমার বুকেও হাদাইছে একখান গুলি। তোরা প্রতিশোধ নিতে ছাড়বি না।’
বিধু ছিল মেডিকেল স্কুলের শেষে বর্ষের ছাত্র, খুব রসিক। মারা যাওয়ার আগেও তার রসিকতা কমেনি। একে একে নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনও শহীদ হলো। হঠাত্ করে একটা গুলি এসে আমার গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিকে বেরিয়ে গেল। দু হাতে গুলি ছুঁড়ছিলাম।এক সময় অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালাম।” এটি ছিল ২২ এপ্রিল ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধ ।
এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমার ধীরগতি চলার কারণেই একসময় মাস্টার দার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তখন লোকনাথদার সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শহরের আশপাশ থেকে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করব সবাই। প্রায় গ্রামে আমাদের দলের ছেলেরা রয়েছে। সেখানে গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
লোকদা আমাদের নির্দেশ দিলেন, অপরাহ্ণ পর্যন্ত ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে। বিকেল ৪টার দিকে ধানক্ষেত থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা ধরলাম। গলায় প্রচন্ড ব্যথা। ক্ষণে ক্ষণে রক্তপাত হচ্ছিল। এক সময় লোকদাকে বললাম-আমি অত্যন্ত দুর্বল বোধ করছি। আমার জন্য আপনাদের পথ চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমাকে রেখে আপনারা চলে যান। লোকদা বললেন, ‘এই অবস্থায় তোমাকে কীভাবে ফেলে যাব।’
ওদিকে বিশ্বাসঘাতক আত্মীয়রা ১০,০০০ টাকার লোভ সংবরণ করতে না পেরে সূর্যসেনের সন্ধান জানিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিসের কাছে। সূর্যসেন ধরা পড়লেন। সাথে তারাকিশোর দস্তিদার ও তরুণী কল্পনা দত্ত। সূর্যসেনের বিশ্বাসঘাতক আত্মীয়দেরকে হত্যা করেন বিনোদ বিহারীর দল। সেখানে তারা পুলিস দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন । চোখের সামনে ১২জন সহযোদ্ধাকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেন বিনোদ বিহারী।
“এরই মধ্যে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতের সর্বত্রই লবণ আইন ভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। কুমিরাতেও কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের শিবির স্থাপিত হলো। ফলে গোপন আশ্রয়স্থল হারাতে হলো। “আন্দোলন দমনের জন্য গ্রামে পুলিশ বাহিনী ক্যাম্প করে। আর এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন আশ্রয়দাতারা।
ঠিক করা হলো, এখান থেকে আমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। কারণ আমি এখানে ধরা পড়লে বাড়ির সবাইকে বিপ্লবীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে জেলে পচতে হবে। সমস্যা হলো কীভাবে পালাই। সে সময় আমার বৌদি বাপের বাড়িতে এসেছেন। তাকে পাঠানো হবে চট্টগ্রামের চাকতাই। বৌদির সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলাম আমিও বউ সাজব। লাল পাড়ের শাড়ি হাতে শাঁখা ও চুড়ি পরে বউ সাজলাম। বিকেল নাগাদ পৌছে গেলাম চাকতাই। পথে দুবার সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ বেষ্টনী পার হয়ে চলে এসেছিলাম।”
‘৪৭-এর দেশ ভাগের চরম সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে লাখ লাখ লোক দেশত্যাগী হতে শুরু করলেও সে পথে এগিয়ে যাননি বিপ্লবী বিনোদ বিহারী। স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধ আর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় দেশের মাটিতেই পড়ে থাকেন।
৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার পাশাপাশি আইন পরিষদেও এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বিপরীতে যুক্ত নির্বাচনী প্রথা কায়েমের জন্য যে আন্দোলন গড়ে ওঠে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে, সে আন্দোলনের অন্যতম মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী।
‘৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে সব রাজনৈতিক দল বেআইনি করলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। ‘৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তাকে আবারো কারারুদ্ধ করা হয়। বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও ‘৬৯ সালের সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
এরই এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতায় অবস্থান নিয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সমর্থনের পাশাপাশি স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গঠন ও শরণার্থী শিবিরগুলোয় ঘুরে ঘুরে সেখানকার শিশুদের শিক্ষাদানের মহান কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হন, তরুনযোদ্ধাদের রিক্রট করে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছেন বিনোদবিহারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল হাতে নিতে পারেননি কিন্তু ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে সংগঠিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। ‘
ছাত্রজীবনের প্রায় পুরোটা সময় বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কেটেছে কারাগারে। কারাগার থেকে বেরিয়ে কিছুকাল তিনি চট্টগ্রামের দৈনিক ‘পাঞ্চ জন্য’-এ সাংবাদিকতা করেছেন, আইন পেশায়ও বেশ খানিকটা বছর কাটিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে তার পর্ণকুটিরেই শিশু-কিশোর দের পাঠদান করে নিজ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও তারুণ্যদীপ্ত শতবর্ষী বিনোদবিহারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে রাস্তায় নামেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন – “আমি বিশ্বাস করি এই বয়সেও আমি জাতির উপকারে আসতে পারি। হতে পারি জাতির পথ প্রদর্শক। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি আমার মূলনীতি সমূহ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যাব। জাতির জন্য অবিরাম কাজ করব। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার দেশের জনগন অত্যাচারিত হচ্ছে। তাদের উপর অন্যায় চলছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিগৃহীত লাঞ্চিত জনগনের জন্য আমাকে আবার যুদ্ধ করতে হবে এবং আরো কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। কেউ আমার পথ রোধ করতে পারবে না। কোন অশুভ শক্তি আমাকে থামাতে পারবে না”।
বিষয় সংশ্লিষ্ট বলে যোগ করছি, যারা আরো বিস্তারিতভাবে বিনোদবিহারী চৌধুরীকে জানতে চান তাদের জন্য ছবিতে-লেখায়-বর্ণনায়-আঁকায়-পৃষ্ঠাসজ্জায় দারুণভাবে তুলে বিশদ প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে ‘অগ্নি পুরুষ’ নামক একটি গ্রন্থে। সাহসী ও সুচারু এই কাজটি করেছেন এ. এম. আব্দুল্লাহ। যিনি একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন । বইয়ের পুরা নাম ‘অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ইংরেজিতে দ্য ফায়ারব্র্যান্ড রিবেল রেভল্যুশনারি বিনোদ বিহারী চৌধুরী।
বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনকে গুরু হিসেবে মান্য করতেন চিরঞ্জীব বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী আর মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করতেন নেতা হিসেবে। শুধু শ্রদ্ধা নয়, মহাত্মার আদর্শ ও দর্শনে তিনি আজীবন পথ চলেছেন, স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করেছেন। একজন সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী, আরেকজন অহিংস আন্দোলনের পথিকৃৎ এই সমন্বয় কি বিনোদবিহারী চৌধুরীর প্রতিকৃতির দোলাচল ???
২০১৩ সালে অগ্নিযুগের সর্বশেষ এই বিপ্লবী ১০৩ বছর বয়সে বিদায় নিয়ে ছিলেন এপ্রিল মাসে, ১০ ই এপ্রিল, যে এপ্রিলেই স্বাধীনতার স্বপ্ন মাখা বুকে বিপ্লবের বীজ বুনেছিলেন তারা ১৯৩০ সালে। আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ ও লাল সালাম।