ফাহাদ বিন হাফিজ॥ সাবেক উপ-সচিব আব্দুল মান্নান। জন্মস্থান চট্টগ্রামের মিরেরসরাই। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। ১৯৯৭ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। জীবনের সব পরিশ্রম, ঘাম ও মেধা দিয়ে এক ছেলে ও দুই মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৪ বছর ধরে একাকী সময় পার করছেন আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসের ৪১৩ নম্বর কক্ষে। আব্দুল মান্নান চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। উপ-সচিব থেকে অবসর নেওয়ার কিছু দিন পরেই তার ঠিকানা হয় নগরীর এই প্রবীণ নিবাসে। সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চেষ্টা করে গেছেন। হয়তো ভেবেছিলেন সন্তানদের পড়াশুনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জীবনের বাকিটা সময় সুখ স্বাচ্ছন্দেই কাটবে তার। জীবনের শেষ সময়ে অসহায় পিতার সহায় হবে সন্তানেরা। কিন্তু বিধি বাম। বৃদ্ধের শেষ ঠিকানা হয় প্রবীণ নিবাসেই। শেষ সময়ে পেনশনে পাওয়া টাকা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে পরে নিঃসঙ্গ জীবন পার করছেন আব্দুল মান্নান।
প্রবীণ নিবাসে থাকা প্রসঙ্গে অভিমানি আব্দুল মান্নান জানান, আমি স্বতন্ত্রভাবেই থাকতে পছন্দ করি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকলে এক কথা, দুই কথা করে অনেক কিছুই হবে। জীবনের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। ছেলে মেয়েরা কি করে এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মান্নান জানান, আমি সচিব ছিলাম এখন প্রবীণ নিবাসে আছি। ওদের পরিচয় দিতে পারবো না। ওদের পরিচয় দিলে ওদের মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। ছেলে মেয়েদের পরিচয় দেওয়া যাবে না। তিনি আরো জানান, বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়ান এক গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি করে। মেঝ মেয়ে ও তার জামাই বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে এবং ছোট মেয়ে মিরপুরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম কলেজের লেকচারার।
ছেলে মেয়েদের আপত্তি থাকার কারণে ছেলে মেয়েদের নাম বলতে চাননি আব্দুল মান্নান। একাকী থাকতে কেমন লাগে এমন প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে গাল বেয়ে গড়াতে থাকে নোনা জল। ছেলে মেয়েরা না এলেও বাবা বলে কথা। সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। ছেলে মেয়েরা পিতাকে না দেখলেও দেওয়ালে টানানো ফ্রেমে বন্দি তাদের ছবিগুলো দ্যাখেন সারাক্ষণ। এখন সময় পার করেন ইসলামী বই, কবিতা, উপন্যাস ও খবরের কাগজ পড়ে। আব্দুল মান্নান যে একজন বইয়ের পোকা তার রুম দেখলেই তা আর মুখে বলে দিতে হবে কাউকে। প্রায় দুই শতাধিক বই রুমে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। অধিকাংশ সময়ই এসব বই পড়ে সময় পার করেন আব্দুল মান্নান। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের এক বন্ধুকে গবেষণার কাজে সাহায্য করছেন তিনি প্রবীণ নিবাসে বসেই।
এভাবেই প্রতিদিন জানালার দিকে অপলক দৃষ্টিতে কার যেনো পথ চেয়ে সময় পার করেন তিনি। নিঃসঙ্গ জীবনে গল্প করার সঙ্গী পেলে তাকে আর সহজে ছাড়তে চান না।
**** ২০০৬ সাল থেকে একই প্রবীণ নিবাসের ৪১৭ নম্বর কক্ষে আছেন জাহাঙ্গীর হোসেন (প্রতীকী নাম)। জাহাঙ্গীর হোসেনের জীবনের গল্পটা আরো করুণ। ৩৫ বছর বিদ্যুত বিভাগে চাকরি করেছেন। যাবতীয় সম্পদ ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার জন্য খরচ করেছেন, নিজের জন্য কিছুই সঞ্চয় করেননি। জীবনের শেষ সময়েও এসে একটা ভুল করেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। চট্টগ্রামের সোসাইটিতে অবস্থিত ৫ কাঠা প্লটের ওপর একটি বাড়ি সন্তানদের নামে লিখে দিয়েছেন। তাই এখন ঠিকানা বলতে এই প্রবীণ নিবাস।
তার জন্মস্থান চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহরেই। বিয়ে করেন সিলেটে। তিন সন্তানের জনক জাহাঙ্গীর হোসেন। বড় মেয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজের কর্মকর্তা। ছোট মেয়ে ও তার জামাই কানাডায় থাকে। দুই সন্তান মাঝে মধ্যে ফোনে যোগাযোগ রাখলেও বড় ছেলে কোনো যোগাযোগ রাখে না। বড় ছেলে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের লেকচারার।
জাহাঙ্গীর হোসেন ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা করে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডে ৩৫ বছর চাকরি করেন। চাকরি শেষে তার ঠিকানা হয়েছে আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসের ৪১৭ নম্বর কক্ষে। শেষ বয়সে জীবনের এই করুণ পরিণতি হবে ভাবতে পারেন নি জাহাঙ্গীর হোসেন।
শেষ বেলায় প্রবীণ নিবাসে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৩৫ বছর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেছি। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করাতে গিয়ে এক টাকাও সঞ্চয় করিনি। জীবনের শেষ বেলায় এসে চট্টগ্রাম শহরে ৫ কাঠা জমি ছিল সেটাই ছেলের নামে লিখে দিয়েছি।
একাকী জীবন কেমন লাগছে এমন প্রশ্নের জবাবে, কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে চোখের নোনা জল মুছতে থাকেন জাহাঙ্গীর। জীবনের শেষ মুহূর্তেও ছেলে-মেয়েদের জন্য ভালোবাসার কোনো কমতি নেই বৃদ্ধের। তাইতো ছেলে মেয়ের কোনো পরিচয় দিতে চাননি। যদি ছেলে মেয়েদের সম্মান যায়! জন্মের পর থেকে তিল তিল করে যে ছেলে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছেন সেই তাদেরই জন্য বোঝা এই বৃদ্ধ।
গত রোববার বাবা দিবসে এসব বাবাদের জীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায় শিল্পী নচিকেতার সেই চিরচেনা সুরে:
ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্লাটে যায় না দেখা এপার ওপার
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
সবচে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি
ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।।