আরাফাতুজ্জামান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি॥ সন্তান হারা এক পিতার আকুতি আর যেন কেউ তার মত প্রবাসী পাত্রের সাথে মেয়ে বিয়ে না দেয়। মেয়ের অধিক সুখের আশায় যে ভুলটি করেছি সেই ভুল যেন আর কেউ না করে। সন্তান হারানোর শোকে মর্মস্পর্শী আদরের কন্যা হারানোর বেদনায় বার বার মুর্ছা যাওয়া পিতা এমনই প্রলাপ করছিল। তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পদ্মাকর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিকাশ কুমার বিশ্বাস। বড় আদরের কন্যা প্রিয়াংকা বিশ্বাসের সুখের কথা ভেবে বড় আয়োজন করে বিয়ে দিয়েছিল তাকে। ছেলে আমেরিকা প্রবাসী কাজল দত্ত। বিয়ের সময় মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র যৌতুক দিয়েছিল তিনি। কিন্তু মেয়ের কপালে সুখ আর জোটেনি। যৌতুক লোভী জামাই কাজলদত্ত ও তার পরিবার আরও যৌতুক দাবী করতে শুরু করে। টাকা দিতে না পারায় ফেসবুক আর মোবাইলে মানসিক অত্যাচার শুরু করে কাজল দত্ত। শেষে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করা হয় প্রিয়াংকা।
জানা যায়, প্রিয়াঙ্কা ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হাটগোপালপুর বাজার এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ কুমার বিশ্বাসের মেয়ে। প্রিয়াঙ্কা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনে সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের বেণিকুন্ডু লেনের কাটনারপাড়া এলাকার প্রশান্ত কুমার দত্তের ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কাজল দত্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর কাজল ১১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এরপর প্রিয়াঙ্কা বাবার বাড়িতে ছিলেন।
প্রিয়াঙ্কার আত্মহননের ঘটনায় তার বাবা বিকাশ কুমার বাদি হয়ে বুধবার জামাতা কাজল, তার মা কনিকা রানী দত্ত-বাবা প্রশান্ত কুমার দত্ত, বোন পুবরী দত্ত ও ভগ্নিপতি শ্যামল সরকারসহ পাঁচজনকে আসামি করে ঝিনাইদহ সদর থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ বগুড়া থেকে কাজলের বাবা প্রশান্ত কুমার দত্ত ও মা কণিকা রানীকে গ্রেপ্তার করে ঝিনাইদহে নিয়ে এসেছে।
বিকাশ কুমার বিশ্বাস জানান, তার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। এ বছরের শুরুতে কাজলের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল। প্রথমে পাত্রপক্ষ ৩০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছিল। তখন তিনি বিয়েতে অসম্মতি জানান। পরে তারা যৌতুক ছাড়াই বিয়েতে রাজি হয়। ১৮ জানুয়ারি প্রিয়াঙ্কার আশীর্বাদ অনুষ্ঠান হয়। এরপর কাজলের বাবা প্রশান্ত দত্ত ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে এ কারণে তিনি ১৯ জানুয়ারি ছেলের মা কণিকা রানীর ব্যাংক হিসাবে ৫ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে তারা আরও টাকা দাবি করেন। ২৯ জানুয়ারি আবারও ওই হিসাবে আরও ২ লাখ টাকা পাঠান।
পহেলা ফেব্রুয়ারি বিয়ের দিন ৮ লাখ টাকা দেন। আরও টাকার দাবিতে শ্বশুর বাড়ির লোকজন প্রিয়াঙ্কার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। এরপর তারা অপবাদ দেন যে প্রিয়াঙ্কা কখনো মা হতে পারবেন না। ১১ এপ্রিল কাজল যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। মেয়েকে তার (বাবার) বাড়িতে নিয়ে আসেন। এখানে থাকা অবস্থায় জামাতা কাজল দত্ত ঠিকমতো খোঁজ নিতেন না। কাজলও প্রিয়াঙ্কার কাছে টাকা চাইতেন।
বিকাশ কুমার আরও জানান, এ পরিস্থিতিতে প্রিয়াঙ্কা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মঙ্গলবার রাত ১১টার পর প্রিয়াঙ্কা অনেকগুলো ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তার ছোট বোন বিষয়টি বুঝতে পেরে পরিবারের অন্যদের জানায়। তাকে দ্রুত ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন বেলা ১১টায় প্রিয়াঙ্কাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হরেন্দ্রনাথ সরকার আমাদের প্রতিনিধিকে জানান, নারী নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।