তাজুল ইসলাম হানিফ॥ হাসনাত আব্দুল হাই ৮০ বছরে পা দিলেন।সৃজনশীল কথাশিল্পী, বিশিষ্ট লেখক এবং প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হাসনাত আব্দুল হাই এর বাড়ী ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার কসবার সৈয়দাবাদ গ্রামে।…..।। অধ্যাপনা দিয়ে তিনি চাকুরি জীবন আরম্ভ করেন। তারপর সিভিল সার্ভিস থেকে সরকারি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন ও ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে অবসর লাভ করেন। হাসনাত আব্দুল হাই এর জন্ম ১৯৩৯ সালে কলকাতায়। তিনি ঢাকা, ওয়াশিংটন, লন্ডন ও কেমব্রিজে লেখাপড়া করেন।
স্যারের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে গুলশানে। স্যার বলেন, বিগত জীবনের জন্য বিলাপ নয়, স্মৃতিচারণ করলেও হবে না, বার্ধক্যের জয়গান গাইতে হবে।’ এই জয়গান যে কাজের মাধ্যমে, মানুষের সঙ্গে আচরণের দ্বারাই সম্ভব; এ কথা তিনি না বললেও বুঝতে কষ্ট হয় না।
হাসনাত আব্দুল হাই স্যারের লেখার উপকরণ : আমি লেখার উপকরণ পাই বিভিন্ন সূত্র থেকে। বেশ কিছু উপকরণ পাই সংবাদপত্রের সংবাদ পড়ে। সংবাদপত্রে মফস্বল পাতায় যে সংবাদ প্রকাশ হয় সেখানে লেখার নানা উপকরণ থাকে। সেগুলো পাঠ করে আমি বেশ কিছু গল্প লিখেছি। আরেকটি সূত্র হলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা কর্মজীবনের। আবার অন্যের জীবনের অভিজ্ঞতা যেটা আমি জানতে পেরেছি সেটাও আমার লেখায় নানাভাবে তুলে ধরেছি। সে অভিজ্ঞতাগুলো আমার গল্প উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রে স্থান পায়। লেখার তৃতীয় সূত্র আমার কল্পনা।
স্যারের কাছে জানতে চাওয়া হয় লেখালেখির শুরুটা কীভাবে?:- পত্রিকায় আমার লেখা একটা ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়। এর আগের বছর বয়েজ স্কাউট হিসেবে পুরো ভারতবর্ষ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ঘুরে এসেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে করে শুধু দিল্লি শহরের বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে লেখাটি লিখেছিলাম। সেটিই ছিল ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম। তখন থেকে শুরু করে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বেশকিছু ছোটগল্প, দুটো উপন্যাস বেরিয়েছিল পত্রিকায়। কিন্তু কোনো বই বের হয়নি। তখন প্রকাশকরা সাহিত্যের বই বের করতেন খুব কম। মাঝখানে অবশ্য চার-পাঁচ বছর বিদেশে ছিলাম। এ সময় কিছুই লিখিনি। আবার যখন আমি সরকারি চাকরিতে ঢুকে ‘৬৫ থেকে ‘৭০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে দায়িত্বরত ছিলাম তখনো কিছু লেখা হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আমি নিয়মিত লিখছি। ১৯৭৮ সালে প্রথম উপন্যাস বই ‘আমার আততায়ী’ বের হয়। এর পরের বছর বের হয় দুটো গল্পের বই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ২৪ বছর অপেক্ষার পর আমার প্রথম বই বের হয়, যা আজকালকার লেখকরা কল্পনাই করতে পারে না।
সাহিত্যের কোন শাখায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান? আমি গবেষণা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা, কলাম লিখি। আমি কবিতা লিখি না। আমার কাছে সব শাখাই প্রিয়। মাথায় যখন একটি চিন্তা আসে তখন সে নিজেই ঠিক করে নেয় কীভাবে সে প্রকাশিত হবে, কোনটা উপন্যাস হবে, কোনটা প্রবন্ধ হবে। দুই ভাবে লেখা হয়- নিজের গরজে এবং অন্যের তাগিদ থেকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে অনুরোধ এলে তখন তাদের চাহিদামাফিক লেখা তৈরি করে দিই। অন্য সময় নিজ থেকে বিভিন্ন লেখা লিখি। আমি মনে করি সৃজনশীল লেখার মধ্যে ছোটগল্প লেখার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। একটা সীমিত পরিসরে একটি কাহিনী পূর্ণরুপে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ছোটগল্প লেখার এই চ্যালেঞ্জ নিতে আনন্দ পাই।
সম্প্রতি কী লিখছেন? এ বছর দুটি উপন্যাস লিখব ভেবেছিলাম এবং লেখাও শেষ পর্যায়ে। কিন্তু একটি পত্রিকার অনুরোধে আরও একটি উপন্যাসে হাত দিতে হবে।
জীবনের অপূর্ণতা কিছু রয়েছে কি? আমি যা কিছু করতে চাই, তা সবটা এখনো পেরে উঠতে পারিনি। এ পর্যন্ত বাংলাতেই বেশি লিখেছি; ইংরেজিতেও কিছু লিখেছি; যেমন তিন খন্ডে স্মৃতিকথা, একটি ভ্রমণকাহিনী, হাইকু কবিতা। আমি চাই ইংরেজিতে আরও বেশি লিখতে যেন বাংলাদেশের কথা বাইরের পৃথিবীতে জানাতে পারি। এই একটা অপূর্ণতা আমার রয়ে গেছে। যত কিছুই করি সবসময় মনে সেই প্রশ্ন জাগে, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’।
তাঁর লিখিত উপন্যাস সমূহঃ ক) সুপ্রভাত ভালোবাসা (১৯৭৭), খ) আমার আততায়ী (১৯৮০), গ) তিমি (১৯৮১), ঘ) মহাপুরুষ (১৯৮২), ঙ) যুবরাজ (১৯৮৫), চ) প্রভু (১৯৮৬), ছ) সুলতান (১৯৯১), জ) সময় (১৯৯১), ঝ) মোড়লগঞ্জ সংবাদ (১৯৯৫), ঞ) একজন আরজ আলী (১৯৯৫), ট) নভেরা (১৯৯৫), ঠ) বাইরে একজন (১৯৯৫), ড) হাসান ইদানীং (১৯৯৫), ঢ) Swallow (১৯৯৬), ণ) Interview (১৯৯৭), ত) সিকস্তি (১৯৯৭), থ) লড়াকু পটুয়া(২০১০)।
পুরস্কার:- ক) বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৭), খ) অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩), গ) জগদীশ চন্দ্র বসু পুরস্কার (১৯৯৫), ঘ) শের-ই-বাংলা পুরস্কার (১৯৯৫), ঙ) এস.এম. সুলতান পুরস্কার (১৯৯৫), চ) শিল্পাচার্য জয়নুল পুরস্কার (১৯৯৬)।