ইসরাত জাহান লাকী॥ দশের যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নৌ-সড়ক-রেল ও আকাশপথের উন্নয়ন প্রকল্পের কিছু চলমান। এছাড়াও নতুন নতুন আরও বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব সেক্টরকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এগিয়ে যাবে দেশের গোটা অর্থনীতি। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ খাতে এগিয়ে থাকতে চায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। দেশের যোগাযোগ সেক্টরের উন্নয়নে এবারের বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব হয়েছে।
সড়ক যোগাযোগ সেক্টরের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ: সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ১ হাজার ১৭৯ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের মান উন্নীত করতে জোনভিত্তিক গুচ্ছ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। এছাড়া পার্বত্য এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১ হাজার ৮৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারাদেশের ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজও এগিয়ে চলেছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও প্রায় ৩৭৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে থাকবে ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা সার্ভিস লেন। সব মিলিয়ে সড়ক যোগাযোগ সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়নের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মহাসড়কে অতিরিক্ত ওজন বহনকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থল ও নৌ-বন্দর এবং পাথর কোয়ারি ও বড় বড় টোল প্লাজায় এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের কার্যক্রমও শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে। সম্প্রতি সংসদে বাজেট বক্তৃতার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাস, রেলওয়ে, নৌযান ও চুক্তিবদ্ধ বেসরকারী বাসে জনগণের যাতায়াত সহজ ও স্বচ্ছন্দ করতে ই-টিকেটিং সিস্টেম প্রচলনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। দেশের মহাসড়ক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পটুয়াখালী জেলার বগা নদীর ওপর নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, বাগেরহাট জেলার মংলা চ্যানেলের ওপর দশম বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু এবং খুলনা জেলায় ঝপঝপিয়া নদীর ওপর একাদশ বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে চীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বদলে যাবে দেশের রেল যোগাযোগের চিত্র: দেশের রেলপথ উন্নয়ন প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রেলপথের গুরুত্ব বিবেচনায় এর নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে আমরা কাজ করছি। এর অংশ হিসেবে দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা, ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর এবং খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ/পুনঃনির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। উদ্বোধনের দিন থেকেই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল সার্ভিস চালু করার লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-নড়াইল-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি।
তিনি জানান, পায়রা বন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন হতে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প আমরা গ্রহণ করেছি। এছাড়া, রোলিং স্টক ব্যবস্থার উন্নয়নে ১০০ এমজি লোকোমোটিভ, ৫৫০ এমজি এবং ১৫০ বিজি যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রেল মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে করিডরকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। জাইকার অর্থায়নে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে একটি রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ ইতোমধ্যে আমরা গ্রহণ করেছি। এছাড়াও, ভারতীয় ঋণের আওতায় খুলনা-দর্শনা সেকশন ডাবল লাইনে উন্নীত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, আখাউড়া-সিলেট সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনাও আছে।
নৌপথেও আসছে ব্যাপক পরিবর্তন : নৌপথ ও বন্দর উন্নয়ন প্রসঙ্গে বাজেটে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় ভৈরব-সিলেট-ছাতক, বিলালপুর-ঘোড়াডিঙ্গা নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ-ঘাগড়াজোড়া নৌপথসহ মোট আটটি নৌপথের নাব্য পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। চীনের আর্থিক সহায়তায় প্রতিটি প্রায় ৩৯ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন তিনটি নতুন অয়েল ট্যাংকার ও তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া, ঢাকাস্থ সদরঘাট টার্মিনাল ভবনের সম্প্রসারণ, তামাবিল স্থলবন্দরে ওয়্যারহাউস নির্মাণ, লঞ্চঘাট এবং ওয়েসাইড ঘাট উন্নয়নে জেটি ও পন্টুন স্থাপনসহ চলমান কার্যক্রম আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে।
আকাশপথেও নানামুখী উদ্যোগ : আকাশ পরিবহনে নানা উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, পর্যটনশিল্প এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে আকাশ পরিবহনের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের সব বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন, অবকাঠামোসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জোরদারকরণে আমাদের চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও টেক্সিওয়ে, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এ্যাপ্রোন ও কানেকটিং টেক্সিওয়ে উন্নয়ন এবং কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বরাদ্দ বেড়েছে ১২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করে এ খাতে ৫০ হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১২ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল ৩৭ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে করা হয় ৩৬ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।
পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ১৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা, সেতু বিভাগে ৮ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, রেলপথ খাতে ১৬ হাজার ১৩ কোটি টাকা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৬৮৭ কোটি টাকা এবং ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৫২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এ বরাদ্দ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ১০ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, সেতু বিভাগে ৯ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, রেলপথ খাতে ১১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৫৪৯ কোটি টাকা এবং ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী যোগাযোগ অবকাঠামোর বিষয়ে বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মানসম্মত যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় এক হাজার ১৭৯ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের মান উন্নীতকরণে জোনভিত্তিক গুচ্ছ প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। এছাড়া বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় এক হাজার ৮৫৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য গুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণের পরিকল্পনাও আমাদের আছে।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বাস, রেলওয়ে, নৌযান ও চুক্তিবদ্ধ বেসরকারী বাসে জনগণের যাতায়াত সহজ ও স্বচ্ছন্দ করতে ই-টিকেটিং সিস্টেম প্রচলনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। সারাদেশের ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণের কাজ এগিয়ে চলছে। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ১৩ কোটি টাকা। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, দেশের যোগাযোগ খাতে বিপ্লব অপেক্ষা করছে। আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে মাথায় রেখে যোগাযোগ খাতের উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বলেন, নতুন নতুন অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি। তথ্য সুত্রঃ জনকন্ঠ