টিআইএন॥ ধ্বংস অনিবার্য পৃথিবীর! সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত! চাঁদ আর মঙ্গলই মানবসভ্যতার ‘নেক্সট ডেস্টিনেশন’! সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে হবে, যেতেই হবে প্রাণে বাঁচাতে, টিঁকে থাকতে, সেই হুঁশিয়ারি আগেই দিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং। এ বার বেছে দিলেন মানবসভ্যতার ‘নেক্সট ডেস্টিনেশন’ বা পরের ‘স্টপেজ’। অন্তত আরও ১০ লক্ষ বছর টিঁকে থাকার জন্য। চাঁদ আর মঙ্গলে। বেছে দিলেন তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহটিকে ‘বাই বাই’ জানানোর সময়ও। হকিংয়ের হিসেবে ৩০ বছরের মধ্যে চাঁদে আর আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে আমাদের গড়ে তুলতেই হবে পরবর্তী সভ্যতা। প্রাণে বাঁচতে, টিঁকে থাকতে। গাছপালা, অন্যান্য প্রাণী, জিন, বংশগতির ধারা, অ্যামিবা, ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল, ছত্রাক, পতঙ্গ সহ বিবর্তনের যাবতীয় টুকরোটাকরা স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে!
নরওয়ের ট্রন্ডহিমে স্টারমাস সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে প্রবাদপ্রতিম পদার্থবিদ, কসমোলজিস্ট হকিং বলেছেন, ‘‘আমি নিশ্চিত, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই আমাদের। এই পৃথিবীটাকে আমাদের ছেড়ে ছুড়ে অন্যত্র চলে যেতেই হবে। এখানে জায়গাটা খুব দ্রুত ছোট হয়ে আসছে আমাদের টিঁকে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য যে সব প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার, তা খুব তাড়া তাড়ি ফুরিয়ে আসছে। উদ্বেগজনক হারে।’’
যেহেতু ‘নস্ত্রাদামু’ নন, তাই কেন সভ্যতার জন্য তাঁর এই হুঁশিয়ারি, সেই কারণগুলিও জানিয়েছেন হকিং। বিজ্ঞানীর যুক্তিতে, প্রজ্ঞার দূর-দর্শনে।
সেই কারণগুলি কী কী?
হকিং বলেছেন, ‘‘পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই। আমাদের এই গ্রহের খুব কাছে থাকা (নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট) গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েড একের পর এক আছড়ে পড়তে চলেছে পৃথিবীর ওপর। এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার রাস্তাগুলি আমরাই এত দিন ধরে তৈরি করেছি, করে চলেছি। আমাদের জন্যই উদ্বেগজনক হারে বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। উত্তরোত্তর দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ‘জ্বর’ বাড়ছে পৃথিবীর। দুই মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে অসম্ভব দ্রুত হারে। বসতি গড়তে যথেচ্ছ বন কেটে ‘নির্বংশ’ করছি গাছপালা। তাতে হইহই করে ভেঙে পড়ছে ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র। বহু প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ। এটা কোনও সায়েন্স ফিকশন নয়। সায়েন্স ফ্যাক্টস বা বৈজ্ঞানিক সত্য। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম ও সূত্র সেটাই বলছে।’’
ইতিহাস এই ভাবেই বাঁক নেয়, পথ বদলায়। সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য নতুন নতুন ঠিকানা খুঁজে নেয়, অতীতে বহু বার নিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে যে অন্য কোথাও গিয়ে এই সভ্যতা একটু ‘নিরাপদ’ কোনও ‘ছাতার তলায়’ দাঁড়াবে, তেমন কোনও জায়গা আর নেই আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে। এমনটাই মনে করছেন হকিং।
হকিংয়ের কথায়, ‘‘এর আগে যখনই সভ্যতা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, বেঁচে থাকা, মাথা গোঁজার জায়গাটা যখন সংকুচিত হয়ে এসেছে মানবসভ্যতার সামনে, তখনই সে নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করে নিয়েছে। ১৪৯২ সালে এই ভাবেই আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন কলম্বাস। কিন্তু পৃথিবীতে আর তেমন কোনও জায়গা পড়ে নেই, যেখানে চলে গিয়ে, সরে গিয়ে এই সভ্যতা বেঁচে থাকতে, টিঁকে যেতে পারবে। এখানে আমাদের জায়গাটা ছোট হতে হতে, হতে হতে পুরোপুরিই ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই যেতে হবে অন্য মুলুকে। কাছেপিঠে বলে, প্রথমে চাঁদে। তার পর ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে। টার্গেট রাখতে হবে যাতে ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে গড়ে তোলা যায় সভ্যতার পরবর্তী উপনিবেশ। আর ৫০ বছরের মধ্যেই উপনিবেশ গড়ে তুলতে হবে, তুলতেই হবে মঙ্গলে। ওই দুই ভিন মুলুকে গিয়ে আমাদের নতুন করে ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, সব প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, অ্যামিবা, শৈবাল, ছত্রাক, পতঙ্গদের নিয়ে।’’
চাঁদ আর মঙ্গল ছাড়াও এই ব্রহ্মান্ডে মানব সভ্যতার আরও একটি ‘নেক্সট ডেস্টিনেশন’ বেছে দিয়েছেন হকিং। বলেছেন, ‘‘সেটা হল, আমাদের সবচেয়ে কাছে, এই সৌরমন্ডলের ‘পাঁচিল’টা টপকালেই যে ‘আলফা সেনটাওরি’ নক্ষত্রমন্ডল রয়েছে, তারই একটি গ্রহ আলফা সেনটাওরি-বি’তেও আমাদের খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। কাজটা খুব কঠিন হবে না, যেহেতু আমাদের থেকে সেই ভিন গ্রহটি রয়েছে মাত্র ৪ আলোকবর্ষ দূরে। মানে, আলোর গতিতে ছুটলে আলফা সেনটাওরি-বি’তে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ৪ বছর। আমরা যদি কোনও মহাকাশযানকে আলোর গতিতে ছোটাতে পারি, আর সেই মহাকাশযানটা চালাতে পারি লেসার রশ্মি দিয়ে, তা হলে আমার বিশ্বাস, আর বড় জোর ২০টা বছর, তার মধ্যেই আমরা পৌঁছে যেতে পারব আমাদের আরও একটা সম্ভাব্য ‘শেল্টার’ আলফা সেনটাওরি-বি’তে।’’
ওই ফেস্টিভ্যালেই হাজির বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান ফিৎজসিমন্স বলেছেন, ‘‘আমাদের ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ার জন্য যে কত গ্রহাণু রয়েছে, সেই সংখ্যাটাই আমাদের এখনও পর্যন্ত জানা নেই। তাই বড্ড ভয়ে আছি আমরা।’’ ফলে, একটু পা চালিয়ে ভাই… তড়িঘড়ি ছেড়ে ছুড়ে দিতেই হবে আমাদের পৃথিবীর এই তল্লাট, দুঃখসুখ, মৌনমুখ, মায়া, মোহ…