মনিরুল ইসলাম॥ রাতে ভালো ঘুম হয়নি । করিম সাহেবের চোখ মুখে বিরক্তি। এখনি বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। রিং বাজতেই ফোন রিসিভ করলেন। ফোন পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। আড় চোখে দেখলেন স্ত্রী রান্নাঘরে। একটা নম্বরে ডায়াল করলেন। নিজে খুব একটা কথা বলতে পারলেন না, ওপাশের কথা শুনলেন। মাসের শেষ, হাতে নগদ টাকা নাই। ব্যাংকে সামান্য সঞ্চয়। বেরুনোর আগে চেকবই সাথে নিলেন। মেজাজটা ফুরফুরে।
লাইনে দাঁড়াতে আজ আর কষ্ট হলো না। অফিসে চেকবইয়ে টাকার অঙ্কটা লিখলেন। পাঁচ লাখ। একটু খারাপ লাগলো। রিটায়ারমেন্টের খুব বেশী বাকী নাই। ছেলেটার অনার্স পাশ করলো। মেয়েটা এসএসসি দেবে। পাঁচ লাখ তুলে ফেললে বাকী থাকবে দুই লাখ সাতচল্লিশ হাজার। চেকে সই করে দিলেন। পাঁচ লাখ টাকা পাঠাতে হবে। তবে পুরস্কারের মূল্যও কম নয়। ২২ লাখ টাকা। একবার ভাবলেন স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেন। কিন্তু পুরস্কারের কথা যে গোপন রাখতে হবে। বহুদিন আগে কেনা নকিয়া সেটটা হাতে নিলেন।
মাস শেষে বিল দেখে গ্রামীণের সিম ব্যবহার করবেন না বলে ও ভেবেছিলেন। ভাগ্যিস ছাড়েননি। লাঞ্চ ব্রেকে বাইরে গেলেন। সরাসরি বিকাশ (মোবাইল অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান) এর দোকানে। পাঁচ লাখ টাকাই পাঠালেন। ভিন্ন ভিন্ন এ্যাকাউন্টে। প্রত্যেকবার টাকা গুনে দোকানদারের হাতে দিচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে জমানো টাকা। খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেই কন্ঠ বারবার মাথার মধ্যে অনুরনিত হয়। “আপনি দুই লাখ সেরা গ্রাহকের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছেন।” করিম সাহেব সারাজীবনই পেছনে ছিলেন। কখনোই কোনকাজে সেরা ছিলেন না। আজ প্রথমবারের মত সেরাদের মধ্যে সেরা। নিজের অজান্তেই গর্বে বুক ভরে যায়। “পুরষ্কার হিসাবে আপনি পাবেন একটি নতুন মাইক্রোবাস অথবা ২২ লক্ষ টাকা নগদ।”
আর্থিকমূল্যেও বিরাট, অন্ততঃ করিম সাহেবের কাছে। চাকুরীতে সুযোগ পেয়েও তিনি নীতিভ্রষ্ট হন নাই। সারাজীবন সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সততার পুরষ্কার বোধহয় তিনি এভাবেই পাচ্ছেন। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি অফিসে ফেরেন। ফুরফুরে মেজাজে সকলের সাথে অফিস ছাড়েন। ড্রইংরুমে টেলিভিশনের চ্যানেল ঘুরাতে থাকেন। পুরষ্কারের টাকা পাবার পর একটা নতুন টেলিভিশন কিনবেন। তাঁর কন্ঠে গুন গুন গান শুনে ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসে। খোদেজা সবসময় কম কথার মানুষ। ৩০ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীর কাছে সেভাবে কোন আবদার করেনি। স্বামীর সামর্থ ও সে জানে। বাসার ফ্রিজটা প্রায়ই নষ্ট হয়। টাকাটা পেলে নতুন ফ্রিজ কিনে এনে খোদেজাকে সারপ্রাইজ দেবেন। খোদেজা ফ্রিজ দেখে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে-করিম সাহেব ভাবতে থাকেন।
তিনদিন কিছুতেই ফুরাতে চায় না। তিনদিন পরেই তিনি পুরস্কারের চিঠি হাতে পাবেন। চতুর্থদিন এসে যায়। আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিসে ঢোকেন। অফিসেই চিঠি আসবে। এই বুঝি চিঠি আসে। সারাদিনই অস্থির করিম সাহেব। অফিস টাইম শেষ। হয়তোবা জ্যামে আটকে আছে কুরিয়ারের গাড়ি। অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। মাগরিবের আযান হয়। এবার করিম সাহেব বাসায় রওয়ানা করেন। নির্ঘুম রাত কাটে। পরের দিন অফিসে গিয়েই সেই নম্বরে ফোন দেন। ফোন যাচ্ছে না। রিডায়াল করতে থাকেন। না, ফোন বন্ধ। সবগুলো নম্বরই বন্ধ। করিম সাহেবের বুকটা কেঁপে ওঠে। পাগলের মত ফোন করতে থাকেন। কোন লাভ হয় না। বুকের ভিতর চিন চিনে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। চোখ খোলেন তিনি। বুঝতে পারেন হাসপাতালের বেডে। এদিক ওদিক তাকান। খোদেজাকে দেখতে পান। তাঁর হুঁশ ফিরেছে দেখে শাড়ীর আঁচলে চোখ মোছে। ছেলেমেয়ে ও আছে। কি হয়েছিল তা মনে করার চেষ্টা করেন। বুঝতে পারেন অফিসেই বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল।
“দ্রুত হাসপাতালে এসেছিলেন, এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন”- ডাক্তারের হাসিমুখ দেখলেন। “স্যার, আচ্ছালামু আলাইকুম। আমি গ্রামীণ ফোন থেকে বলছি। যারা দীর্ঘদিন গ্রামীণ ফোন ব্যবহার করছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে কখনো কোন অভিযোগ হয়নি, এমন দুই লাখ সেরা গ্রাহকের মধ্যে লটারী করা হয়েছে। সেরা দুই লাখ গ্রাহকের মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ্যবান আপনি। আপনি পুরষ্কার হিসাবে পাবেন একটি বারো সিটের নতুন মাইক্রোবাস কিংবা ২২ লাখ নগদ টাকা। পুরস্কারের চিঠি হাতে পাওয়ার আগে কাউকে একথা বলা যাবে না। আপনি দয়া করে এখনই ০১৭১৪৩২৭………..নম্বরে ফোন করুন।” ফোন ব্যাক করতেই অফিসিয়াল ফর্মালিটিজগুলো খুব সুন্দর ভাবে বোঝানো হয় করিম সাহেবকে। গাড়ীর কাগজপত্র রেডি এবং রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে। ছেলেটা এতো ভদ্র ও বিনয়ী, কোন সন্দেহ হয়নি তাঁর। নানা কথা ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যায়। তিনদিন পর আবার অফিস যেতে শুরু করেন করিম সাহেব।
গ্রামীণ ফোন অফিসে যোগাযোগ করে জানা যায় এরকম কোন লটারী কিংবা পুরষ্কার প্রদানের বিষয় পুরোপুরি ভিত্তিহীন। করিম সাহেব প্রতারিত হয়েছেন। তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় এভাবে প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিল! কেন কারো সাথে শেয়ার করতে বারণ করেছিল তা তিনি বুঝতে পারেন। নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছা করে তাঁর। পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর শেয়ার না করার কোন কারণ ছিল না-এটি কেন তাঁর মাথায় আসেনি। গ্রাহক বাড়ানোর কৌশল হিসাবে ফোন কোম্পানী কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রচার করে। কিন্তু এই ধরনের পুরস্কারের কথা জানালে তো গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ এই ব্যাপারে কোন বিজ্ঞাপন কিংবা বিজ্ঞপ্তিতো তাঁর চোখে পড়েনি। এসব চিন্তা কেন যে মনে আসে নি! এজীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করবেন না। করিম সাহেব চরম ধাক্কা খেয়ে শিখলেন।
প্রতারণা ও প্রতারকের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সময়ের সাথে সাথে শুধু ধরণ পাল্টায়। আমরা যদি একটু সতর্ক হই, চিন্তাভাবনায় যৌক্তিক হই, অন্তর থেকে লোভ পরিহার করি তা’হলে প্রতারিত হবার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে। লেখক: পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের প্রধান