মহিউদ্দিন মাহি॥ ‘লানু (নানু) আমাদের জন্য আম, খেজুল (খেঁজুর) পাঠাইছে। আমরা খাইছি। লানুর কাছে আমরা যাব। আমাকে জামা দেবে।’ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ঈদের আগে কথাগুলো বলে প্রধানমন্ত্রী নাতি সৈয়দ আলী মর্জুতা আযান। সে রাজধানীর নিমতলী ট্র্যাজেডির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যা বনে যাওয়াদের একজন উম্মে ফারুয়া আক্তার রুনার বড় ছেলে। এবার রমজানের পঞ্চম দিন প্রধানমন্ত্রী তার তিন কন্যার জন্য আম, খেঁজুর পাঠান। প্রতিবছরই এই রীতি পরিপালন করে আসছেন তিনি। দুই ঈদে জামা-কাপড় দেন। নিয়মিত খোঁজ রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন মহানুভবতার কথা জানিয়ে রুনা বলেন, ‘মা আমাদের নিয়মিত খোঁজ নেন। প্রতি রমজানে আমাদের জন্য খাবার পাঠান। জামা-কাপড় দেন। আমাদের জন্য অনেক করেন।’
রুনা দুই সন্তানের জননী। প্রথম সন্তান আযানের বয়স ছয় বছর। আর দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে মাস দেড়েক আগে। তার নাম সৈয়দ আলী মোহাম্মদ সুজাত। আযান উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নার্সারিতে পড়ে। রাজধানীর হোসেনী দালান এলাকার শিয়া গলির ৮/১০ নম্বর বাসার তৃতীয় তলায় থাকেন রুনা। সম্প্রতি এই বাসায় রুনার সঙ্গে যখন আমাদের কথা হয়, তখন তিনি নবজাতক শিশুকে সরকারি টিকা দিয়ে এসেছেন। কেমন আছে নতুন অতিথি? জানতে চাইলে রুনা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ভালোই আছে।’
এই খবর কী মাকে দিয়েছেন?-হুমমম। মাকে সন্তান হওয়ার পরপরই জানিয়েছি। তিনি দোয়া করেছেন। রুনার স্বামী রাশেদ হাসান জামিল নৌবাহিনীতে চাকরি করেন। বিয়ের পরপরই এই চাকরি প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে ভালোভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন রুনা।
রুনার উকিল বাবা সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। এখন তাদের খুব একটা খোঁজ নেন না তিনি। রুনা বলেন, ‘হয়ত নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই আসতে পারেন না।’
প্রধানমন্ত্রীর আরেক মেয়ে সাকিনা আক্তার রতœা। তিনি থাকেন নবাব কাটরা ৯/১ এর এ নম্বর বাসায়। তিনিও বেশ ভালো আছেন। জানালেন, ‘মা নিয়মিত খোঁজ নেন। প্রধানমন্ত্রীর হয়ে শেখর কাকা সব সময় খোঁজ রাখেন। এই তো সেদিন আমাদের ছবি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
কেন ছবি নিয়েছেন? -জানি না। তবে শেখর কাকা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের তিন বোন, স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি চেয়েছেন। আমরা মেইলের মাধ্যমে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি।
ছবি দিয়ে কী করবেন, বলেননি? -না, ছবি দিয়ে কী করবেন সেটা আমরা জানি না। তবে ভালো কিছুই হবে বলে মনে করি।
কেমন চলছে আপনাদের দিনকাল?
-অনেক ভালো চলছে। মা সব সময়ই খোঁজ রাখেন। আমার যে উকিল বাবা এম এ আজিজ, তিনি তো মারা গেছেন। তিনি প্রতিদিন আমাদের খোঁজ নিতেন। কিন্তু এখন উকিল মা নিয়মিত খোঁজ রাখেন। আমি উকিল মার জন্য জামা-কাপড় কিনেছি, কালকে তাকে দিয়ে আসব।
রত্মার স্বামী সাইদুর রহমান সুমন বেসিক ব্যাংকে চাকরি করেন। এই চাকরিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত জানুয়ারিতে রতœার স্বামীর পদোন্নতি হয়েছে। এ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত রত্মা। বললেন, আমরা এখন অনেক ভালো আছি। মায়ের সহযোগিতায় ভালোই চলছে আমাদের সংসার। রত্মার একমাত্র কন্যা আয়াতুল রহমান শ্রদ্ধা। তার বয়স পাঁচ বছর।
প্রধানমন্ত্রীর আরেক কন্যা আসমা আক্তার। তার স্বামী আলমগীর হোসেন সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। তার চাকরিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে খুব ভালোভাবেই চলছে আসমার সংসার। আসমার বড় ছেলের নাম আকিব হোসেন রমাদান। তার বয়স প্রায় ছয় বছর। আর ছোট ছেলে আয়াত হোসেন আদরের বয়স সাড়ে তিন বছর। আসমা থাকেন ইসলামবাগে। তার বাসায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কথা হয়েছে মুঠোফোনে।
কেমন আছেন?
-আল্লাহ খুব ভালো রেখেছেন।
-মার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে দেখা হয়?
-হ্যাঁ, মার সঙ্গে দেখা হয়।
এবার হবে?
-এখনো জানি না। তবে মা সব সময় খোঁজ রাখেন। এবারও রমজানে আম, খেঁজুর পাঠিয়েছেন মা। প্রতি ঈদেই মা জামা-কাপড় দেন। এবারও দিয়েছেন।
উকিল বাবা খোঁজ নেন?
-আমার উকিল বাবা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন নিয়মিত আমাদের খোঁজ নেন।
পুরান ঢাকায় বসবাসকারী রুনা, রতœা আর আসমা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন কন্যা। আশপাশের বাসিন্দারাও তাদের সেই সম্মানের চোখে দেখেন। তাদের সন্তানদেরও স্নেহ দেন প্রধানমন্ত্রীর নাতি-নাতনি হিসেবেই। এক ট্র্যাজিক ঘটনার পরম্পরায় রুনা, রতœা আর আসমাকে মেয়ের আদরে আঁচলের ছায়ায় নেন শেখ হাসিনা।
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনে আপন দুই বোন রুনা ও রতœা তাদের মা, ভাইসহ নিকটাত্মীয় সাতজনকে হারান। ওই রাতেই নিমতলীর বাসায় বাগদান হওয়ার কথা ছিল রুনার। সেই আয়োজনও সম্পন্ন ছিল। ততক্ষণে বরপক্ষের লোকজনও এসেছিলেন রুনাদের বাসায়। সেখানে বরপক্ষের পরিবারেরও সাতজন পুড়ে মারা যান। রতœার বিয়ের তারিখও পাকা করা হয়েছিল ওই মাসেরই ১৯ তারিখে। আগুন লাগার আগেই দুই বোন রূপসজ্জার জন্য পার্লারে থাকায় বেঁচে যান।
আসমার বিয়ের কথাও পাকাপাকি ছিল। যে রাতে আগুন লাগল এর পাঁচ দিন পর তার বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। তবে আগুনে কেড়ে নেয় আসমার মা, খালা, ভাতিজিসহ তিনজনকে। ভাবি আর বাবা গুরুতর দগ্ধ হন। কোনো রকমে আগুন থেকে রক্ষা পান আসমা।
এমন পরিস্থিতিতে ওই তিনজনের যখন কেউই ছিল না তখন পরম মমতায় তিন কন্যার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু কি দায়িত্ব? নিজের মেয়ে হিসেবেও স্বীকৃতি দেন তাদের। আগে থেকে ঠিক করা পাত্রদের সঙ্গে তাদের বিয়ে দেন।
দুর্ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় ৯ জুন গণভবনে মহা ধুমধামে শেখ হাসিনা তাদের বিয়ে দেন। নিজেই তিন কন্যাকে মায়ের মমতা দিয়ে ভুলিয়ে দেন মা হারানোর বেদনা। গণভবনের ওই বিয়েতে প্রধানমন্ত্রী পুরো বাঙালিয়ানা পরিবেশে কন্যাদের তুলে দেন বরের হাতে। তিনজনের স্বামীকেই নিজের মেয়েজামাই স্বীকৃতি দিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও দেন প্রধানমন্ত্রী।
স্থানীয় তিন আওয়ামী লীগ নেতাকে তিন কন্যার উকিল বাবার দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের মধ্যে রুনার উকিল বাবা হন হাজী সেলিম, রতœার উকিল বাবা হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ আর আসমার উকিল বাবা হন তৎকালীন সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
জীবনের বাস্তবতা আর ব্যস্ততায় প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যা পুরান ঢাকার পৃথক তিনটি এলাকায় থাকেন। নিজেদের উকিল বাবা তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন। তবে কড়া নিরাপত্তা আর নানা প্রটোকল পেরিয়ে চাইলেই এ তিন কন্যা তাদের মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। নানা উৎসব, অনুষ্ঠান আর জাতীয় দিবসে মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান তারা।