সম্পত্তি স্ত্রী-সন্তানের নামে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাই হলো ইঞ্জিনিয়ার তৈয়বের

রাইসলাম॥ নিজের জন্য সঞ্চয় করো। বৃদ্ধ বয়সে কাজে আসবে। সন্তানদের কাছে হাত পাতা লাগবে না। নিজের টাকা নিজে খরচ করতে পারবে। তোমাদের ভবিষ্যত যেন আমাদের মতো না হয়! আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস ও হাসপাতালের বাসিন্দা আবু তৈয়ব (৭২)। এসময় তিনি বলছিলেন, ১৫ থেকে ২০ দিন হলো চশমাটা ভেঙে গেছে। ঠিক করতে পারিনি। জামাই নিয়ে গেছে। এখনো ফেরত পাইনি।
বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ উদযাপন করেছেন সুবিধাবঞ্চিত অসংখ্য বাবা ও মা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ব্যক্তিদের সন্তানেরা বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত। এরপরও তাদের ঈদ করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। সংসার বিচ্ছিন্ন লোকচক্ষুর আড়ালে পরবাসে থাকে অনেকেরই বাবা-মা। গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে থাকা ওইসব বাবাদের একজন আবু তৈয়বের সঙ্গে কথা হয়। শোনালেন তার বেদনাময় ঈদ উদযাপনের কথা।
বুধবার সকালে গোসল শেষে আবু তৈয়ব কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গণমাধ্যম থেকে এসেছি জেনে বের না হয়ে শুরু করলেন এবারে ঈদ উদযাপন ও জীবনের গল্প। বলছিলেন, ৭২ বছর বয়সে প্রবীণ নিবাসে তিন বছর ঈদ উদযাপন করেছেন আবু তৈয়ব। প্রতি ঈদের আগেপরে ছেলে-মেয়েরা দেখা করতে আসলেও আসেন না তার স্ত্রী। স্ত্রী ছোট মেয়ের সাথে সাভারে থাকেন। ছোট মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং পড়ছেন।
নিজের অতীত স্মতিচারণ করে আবু তৈয়ব বলেন, আমি জীবনে অনেককে বটগাছে উঠিয়েছি (বড় করেছি)। আর আমি এখন বটগাছের নিচে (বৃদ্ধাশ্রমে)। নিজের সন্তান ছাড়াও শ্বশুরের দুই ছেলেকে মানুষ করেছি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, জীবনে কয়েকটি ভুলই আমায় এখানে (বৃদ্ধাশ্রমে) নিয়ে এসেছে। কোন ভুলগুলো জানতে চাইলে আবু তৈয়ব বলেন, নিজের নামে কিছু না করে স্ত্রী-সন্তানের নামে সম্পত্তি করেছি। পেনশন বিক্রি করে না বুঝে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। শেষ বয়সে ব্যবসা করতে গিয়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকা নষ্ট করেছি!
তিনি জানান, তার নিজের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দুই শ্যালককে লেখাপড়া করিয়েছেন। এমনকি সাভারে নিজের টাকায় কেনা এক বিঘা জমিও দুই শ্যালকের নামে লিখে দিয়েছেন। বাবা-মা হারা শ্যালককে নিজের সন্তানের মতো বড় করেছেন। এখন শ্যালকরাও কোনো খোঁজখবর নেয় না। অন্যদিকে, তিন ভাতিজা-ভাতিজিকে নিজের টাকা খরচ করে পড়াশুনা করিয়েছিলেন। তারাও এখন বড় বড় অফিসে চাকরি করে। প্রাইভেটকারে চেপে চলাফেরা করে। অথচ খোঁজখবর রাখে না।
ক্ষোভের সঙ্গে আবু তৈয়ব বলেন, এমনকি বউয়ের নামে সাভারে দেড় বিঘা জমি লিখে দিয়েছি। অনেক কষ্টে গড়া নিজের সুখের সংসারে শেষ বয়সে নিজেরই স্থান হলো না।  তার কয় ছেলেমেয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে লেখাপড়া করে।
ঈদ কেমন কাটলো এমন প্রশ্নের জবাবে আবু তৈয়ব বলেন, ছেলে-মেয়েরা খোঁজ খবর নিলেও স্ত্রী কোনো খবর নেয়নি। ছেলে-মেয়েরা এখন নিজেরা নিজেদের মতো করে মায়ের সঙ্গে থাকে। তিনি বলেন, চাকরি জীবনে কত লোক ঈদের দিনগুলোতে আসতো। ফোন দিতো। অথচ এখন জীবনের শেষ দিকে এসে কেউ খোঁজখবরও নেয় না। ঈদের দিনটি কাটছে নীরবে-নিরানন্দে! এখানে বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তারাই এখন আমার আত্মীয়। তারাই নিয়মিত খোঁজখবর নেন।
কর্মজীবন আবু তৈয়ব ছিলেন গণপূর্ত অধিদফতরের (পিডব্লিউডি) ইঞ্জিনিয়ার। জন্মস্থান নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চাকরি-জীবন ছিল তার। এরপর অবসরে যান।  আগারগাঁওয়ের হাসপাতালটি বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান নামে পরিচিতি। শেষ বয়সে এই প্রতিষ্ঠানের ৫১০ নম্বর কক্ষে দিন কাটছে আবু তৈয়বের। ছিমছাম, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। এখানে যে মানুষ থাকে, বাইরে থেকে তা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই।
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ এস এম আতীকুর রহমান বলেন, প্রবীণদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এখানে যারা থাকেন, যদিও তারা পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকেন, তারপরও এখানে পরিবারের মতোই থাকেন। এখানে যারা আছেন, তারা উচ্চশিক্ষিত ও কর্মজীবনে তারা অনেক দিন কাজ করেছেন। আমি লক্ষ করেছি, অনেকে একা থাকতে পছন্দ করেন। অনেকের আত্মীয়স্বজন থাকলেও তারা ঈদের দিন দেখা করতে আসেন না।
কথা হয়, এই প্রবীণ হাসপাতালের ডাক্তার মো. আমানুল্লার সঙ্গে । তিনি জানান, এখানে প্রবীণরা এক সঙ্গে থাকার ফলে তাদের কষ্টটা অনেকাংশেই দূর হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের চিকিৎসার জন্য এখানে হাসপাতাল রয়েছে। প্রায় ২৫ জন চিকিৎসক তিন শিফটে এখানে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় তাদের।
তিনি আরো জানান, বৃদ্ধরা তাদের একাকিত্ব দূর করার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। কারণ, তাদের সন্তানরা তাদের সময় দিতে পারেন না। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। এ সময় তাদের মধ্যে নানা রকম সমস্য দেখা দেয়। তাই, তাদের বেশির ভাগই এখানে ভালো থাকার জন্য আসেন। ঈদে তাদের জন্য ছিলো বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা।
মো: আমান উল্লাহ জানান বৃদ্ধাশ্রমে যতই ভালো থাকুক, নিজের বাড়ির মায়া আর একাকিত্ব দূর করা সম্ভব হয় না। কারণ, পরিবার পরিবারই! বৃদ্ধাশ্রম সেই অভাবটা পূরণ করতে পারেনা। আমরা চাই, সবাই তাদের পরিবারের সঙ্গেই জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.