গোলাম মওলা॥ প্রায় অর্ধশতাধিক খাতে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট দিতে হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যসহ বেশ কিছু খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফলে ১ কোটি টাকার বেশি বার্ষিক টার্নওভার হওয়ার পরও বেশ কিছু ব্যবসা, সেবা, আমদানি ও উৎপাদন করা পণ্যে ভ্যাট দিতে হবে না। গত ১ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়া পণ্যগুলো হলো- কনডমসহ সকল প্রকার জন্ম নিরোধক, ইনসুলিন, ভ্যাকসিন ফর হিউম্যান মেডিসিন, লিভার সিরোসিস বা হেপাটাইটিস সি নিরাময়কারী ওষুধ, ভ্যাকসিন্স ফর ভেটেরিনারি মেডিসিন, হোমিওপ্যাথিক, আর্য়ুবেদিক, ইউনানি ও ভেষজ ওষুধ সামগ্রী, কিডনি ডায়ালাইসিস সলিউশন ও ইনসুলিন পেন। পাশাপাশি ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ রোগ নিরোধক ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও ভ্যাকসিনকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমদানি পর্যায়ের এসব পণ্যে কোনও ভ্যাট দিতে হবে না।
এছাড়া ব্যবসা পর্যায়ে কম্পিউটার প্রিন্টারের রিবন, ২২ ইঞ্চির চেয়ে ছোট কম্পিউটারের মনিটর, প্রিন্টার, প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, টোনার কার্টিজ ও মোবাইল টেলিফোন সেট, মডেম, ইথারনেট ইন্টারফেস কার্ড, নেটওয়ার্ক সুইচ, হাব, রাউটার অপারেটিং সিস্টেমে কোনও ভ্যাট দিতে হবে না। এর বাইরে সব ধরণের পাটজাত পণ্য, কৃষিকার্যে ব্যবহার্য ইনসেকটিসাইড, ফাংগিসাইডস, পেস্টি সাইডস, এন্ট্রি স্প্রাউটিং প্রোডাক্ট, প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটর, সব ধরণের সার, সব ধরণের চাল, ভুট্টা বীজ (শুধু মাত্র মোড়কজাত অবস্থায়) পণ্যে ভ্যাট দিতে হবে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বসানোর ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে কি ধরণের প্রভাব পড়ে সেটা দেখেই অব্যাহতি দেওয়া হয়। এতে ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়া পণ্য বেশি হওয়ায় রাজস্ব আহরণে কিছুটা প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, বাজেট বাস্তবায়নেও চাপ পড়বে।’
এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, সেবার ক্ষেত্রে মেডিটেশন সেবা, অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে ভ্যাট দিতে হবে না। এছাড়া স্কুলের টিফিন সরবরাহ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক কার্যাদেশের বিপরীতে মুদ্রিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ও সমমান পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, তুলা সরবরাহ, ওয়েস্ট অ্যান্ড ক্র্যাপ পেপার সরবরাহ, ভাঙা কাচের টুকরা সরবরাহ, প্লাস্টিক বর্জ্য সরবরাহ, জিলেটিন ক্যাপসুলের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত গরু ও মহিষের হাড়, স্টিল মিলে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত স্ক্যাপ বা ভাঙারি সরবরাহ, পাটজাত পণ্য সরবরাহ, খাদ্য শস্য সরবরাহ করা পরিবহনে কোনও ভ্যাট দিতে হবে না।
এর বাইরে ভূমি বিক্রয়কারী, সেচ কাজে ও হিমাগার সেবায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ, টেইলারিং সপ ও টেইলার্স (শীতাতপ ব্যতিত) পর্যটন স্থান, স্থাপনা (ঐতিহাসিক স্থানসহ), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান, নিবন্ধিত উৎপাদনকারী কারখানা ভাড়া, আবাসিক কাজে ব্যবহারের জন্য স্থাপনা, নিবন্ধিত তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর স্থাপনায় কোনও ভ্যাট নেই।
একইভাবে স্টক ও সিকিউরিটি ব্রোকার, ট্যুর অপারেটর, গ্রে- ফেব্রিক্সের ডাইং, প্রিন্টিং ফিনিশিং ও ক্যালেন্ডারিং সংক্রান্ত সেবা, পত্রিকায় প্রকাশিত মৃত্যু সংবাদ, পুস্তুক, সাময়িকী ও ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষামূলক দ্রব্যাদি মুদ্রণের চার্জের ওপর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সেবার ক্ষেত্রে, ফটো নির্মাতা, হিমাগারে কোনও ভ্যাট নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সব অস্থায়ী হোটেল ও রেঁস্তোরায় (অস্থায়ী বেষ্টনিবিহীন, বিদ্যুৎ-ফ্যানবিহীন) কোনও ভ্যাট দিতে হবে না।
উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট দিতে হবে না, এমন পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, হ্যারিকেন বাতিতে ব্যবহার্য চিমনি, বল পয়েন্ট পেন, সুতার তৈরি ফেব্রিক্স, কঠিন শিলা, ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উৎপাদিত জালের কাঠি, কোদাল, বেলচা, কড়াই, তাওয়া, বাটখারা, রাইস হলার, হুইট ক্রাশার, রাইস হলারের জালি, ব্লেড, বাটম, সেচ পাম্প, হস্তচালিত টিউবওয়েল, গৃহস্থালির তৈজসপত্র, স্যানিটারি ওয়্যার, সেচ পাম্প ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, ফিশিং ট্রলার ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, কৃত্রিম কিডনি, ডেইরি মেশিনারি, টেক্সটাইল ও জুট মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ, বাংলা বা বাংলা-ইংরেজি দোভাষিক টাইপ রাইটার মেশিন, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, সোলার ব্যাটারি, মোবাইল টেলিফোন সেট, সফটওয়্যার, ৪০ আসন বা ততোধিক আসনের বাস, পণ্য পরিবহনকারী ট্রেইলর ইত্যাদি।
ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য, ইঁদুর মারার বিষ, সিপসাম ড্রাই হাইড্রেট সার, প্লাস্টিক দানা, প্লাস্টিকের তৈরি থালা, বাসন, পেয়ালা, বাটি, মগ, জগ, গ্লাস সবজি ধোওয়ার জন্য জালি, গামলা, বালতি, খাবার ঢাকার ঢাকনি, স্কুলের বাচ্চাদের পানির বোতল, ঝুড়ি ও টিফিন ক্যারিয়ার, বদনা, সাবানদানি, বেবি পর্টি, বেড প্যান, বেবি বাথটাব, মশলার ট্রে, সালাদ কাটিং বোর্ড, পিড়ি বা টুল, ডিস র্যাক, ময়লার ঝুড়ি, প্যাডেল বিন, ডাস্ট প্যান, গ্লাস স্ট্যান্ড, হাতপাখা, নিউজপ্রিন্ট, রেশম সুতা, সব ধরণের লবণ, এলপি গ্যাস (বোতল বা সিলিন্ডারজাতকারী) বিদ্যুৎ, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার, জিনক সালফেট, ফেরাস সালফেট, প্রোভিটামিনস ও ভিটামিন, প্যাকেটকৃত তরল দুধ, পনির, মাঠা, ভোজ্য কাচা মাংস, কাচা মাছ, দেশে উৎপাদিত মরিচ, আদা, ধনিয়া, হলুদ, চাল, গম, ভুট্টা, চাল/গম/ভুট্টার তৈরি সুজি, সানফ্লাওয়ার সিড ওয়েল, চালের কুড়ার তেল, চিনি ও আখের গুড়, অপ্রক্রিয়াজাত তামাক, পেয়াজ, রসুন, শাক-সবজি, ফুলের তোরা, তরমুজ, পেঁপে, আংগুর, লেবুজাত ফল, ডুমুর আনারস, পেয়ারা, আম, গাব, কলা, বাদাম, সুপারি, নারিকেল, আপেল, নাশপাতি, কোইন্সে কোনও ভ্যাট নেই।
এছাড়া কাঠপেন্সিল, হারিকেন বাতি, হাসপাতাল শয্যা, হার্ট বাল্ব, কম্পিউটার মডেম, কেরোসিন চুলা, পুস্তক, পুস্তিকা, সংবাদপত্র, পত্রিকা, সাময়িকী, সব ধরণের চেরাই কাঠ, সরিষার তেল, ফুল ফ্যাট সয়াবিন, গমের ময়দা বা আটা (আড়াই কেজি পর্যন্ত)। আলু বীজ, খেজুর, ধান বীজে কোনও ভ্যাট নেই বলেও জানিয়েছে এনবিআর।
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই থেকে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও আগামী দুই বছর তা হচ্ছে না। ফলে বিগত দিনগুলোর মতোই আগামী দুই বছর প্যাকেজ ভ্যাট বহাল থাকছে। একইভাবে পণ্য ভেদে একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করা হবে।