মাহবুব রেজা: কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক॥ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে দলের নীতিনির্ধারক মহলের একটি অংশ। তাদের অসহযোগিতার কারণে ফখররুল সাহেবকে বেশ ঝামেলা আর ভোগান্তির মধ্যে আছেন- দলীয় একাধিক সূত্র থেকে এ ধরনের আভাস পাওয়া যায়। এসবের কারণে দলের মহাসচিব কোনোদিকে কোনো কূল-কিনারা করতে পারছেন না। না দলে, না নিজের ব্যাপারে। এরকম পরিস্থিতিতে মহাসচিবের কান্নাকাটি করা ছাড়া কি-ই বা করার আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দলের দুটি সভায় কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার সময় তাদের দুঃখ-কষ্ট আর অসহায়ত্ব তুলে ধরতে গিয়ে মহাসচিবের প্রকাশ্যে কান্নাকাটির বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে সূত্রটি জানায়, মহাসচিবের এই কান্না কি আসলে দলের কর্মীদের দুঃখ-কষ্টকে স্মরণ করে নাকি দলে নিজের অসহায় অবস্থার কথা স্মরণ করে?
জানা যায়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রেকর্ড সময় ধরে দলের ‘ভারপ্রাপ্ত’ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ফখরুল ইসলাম দলের পূর্ণ দায়িত্বে গদিনসিন হয়েছেন। তার এই গদিনসিন হওয়া নিয়েও কম নাটক হয়নি বিএনপিতে। তার মহাসচিব হওয়ার বিষয়টিকে দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তবে ফখরুল ইসলামের প্রতি চেয়ারপারসনের বিশেষ আস্থা থাকার কারণে নেতারা বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করতে পারেননি। তবে মহাসচিবকে কিভাবে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করা যায় সে ব্যাপারে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন তারা। তারপরও অপেক্ষাকৃত সজ্জন বলে এখনো দলের রাজনীতিতে তিনি টিকে আছেন।
সূত্রটি আরও জানায়, দলের ভেতরে মহাসচিবকে নিয়ে স্থায়ী কমিটিসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার প্রবল বিরোধিতায় তিনি কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করতে না পারার সব ব্যর্থতা মহাসচিববিরোধী নেতারা তার কাঁধে চাপিয়ে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বোঝাতে সক্ষম হলেও এখন পর্যন্ত তারা চেয়ারপারসনকে কব্জা করতে পারেননি।
স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও এক সময়ের প্রভাবশালী আমলা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, মহাসচিবকে দিন দিন কোণঠাসা করার নীতি নিয়ে দলের একটি অংশ ঘোষণা দিয়ে বিরোধিতায় নেমেছেন। এসব নেতা সুপরিকল্পিতভাবে প্রতিদিন যে যার মতো করে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের ‘স্বঘোষিত মুখপাত্র’ সেজে মিডিয়ার সামনে একেকজন একেক রকম বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে মহাসচিব ও দলের ইমেজকে ক্ষুণœ করছেন। তিনি এই নেতাদের প্রেস ব্রিফিং আর সংবাদ সম্মেলননির্ভর উল্লেখ করে জানান, এসব নেতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করেই মহাসচিবের ভূমিকায় নিজেদেরকে নামিয়ে আনেন যা কারো জন্যই কাঙ্খিত নয়। স্থায়ী কমিটির এই সদস্য জানান, দলের অনেক ব্যবসায়ী নেতা ও সাবেক মন্ত্রীরা সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশয়ে ব্যবসা-বানিজ্য বাগিয়ে নিয়ে সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাদের বি- টিম হয়ে দলে আত্মঘাতী ভূমিকায় নেমেছেন।
দলে উদারপন্থি বলে পরিচিত সাবেক বাম দল করা এক নেতা বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মারপ্যাঁচ আর কয়েকজন বর্ষীয়ান নেতা ও স্বঘোষিত মুখপাত্রদের কথা উল্লেখ করে জানান, ভদ্র ও সজ্জন হিসেবে পরিচিত ফখরুল ইসলাম আলমগীর এদের পাল্লায় পড়ে আসলে কতটা ভালো আছেন তা নিয়ে অন্যদের কথা বাদই দিলাম, আমাদের মধ্যেই বিস্তর প্রশ্ন আছে। তিনি আরও জানান, মহাসচিবকে নানাভাবে কোণঠাসা করার ঠান্ডা যুদ্ধে স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য শুরু থেকেই তৎপর আছেন। তারপরও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে ফখরুল ইসলাম আলমগীর আপাতত নিজের জায়গা করে নিলেও দলে যে তিনি বেশ চাপের ভেতর রয়েছেন তা তার কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়।
দুই.
এদিকে বিএনপি মহাসচিবের দলের কর্মীদের সামনে কান্নাকাটি করার বিষয়টি অরিজিনাল না মেকি তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পক্ষে-বিপক্ষে সরব আলোচনা- সমালোচনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবের কানাকাটি প্রসঙ্গে বলেছেন, তারা বসে বসে প্রেস ব্রিফিং করে আর কান্নাকাটি করেন, তাদের কর্মীদের কষ্ট হয় বলে। কিন্তু তারা তো আমাদের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করে রক্ত স্রোত বইয়ে দিয়েছেন। আমাদের কাঁদতে কাঁদতে এখন চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা মহাসচিবের এই কান্নাকাটির ব্যাপারটিকে রাজনীতিতে পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। তারা বিষয়টিকে হাল্কাভাবে না দেখে বলছেন, বিএনপির মতো এত বড় দলের মহাসচিব হিসেবে তিনি নেতা-কর্মীদের দুঃখ-কষ্টে আবেগবশত কাঁদতেই পারেন। তবে এর ভেতরে কেউ যদি অন্য কিছু দেখতে চান সেটা তাদের ব্যাপার।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এক সময় ঢাকাই সিনেমায় বিউটি কুইন শাবানাকে বলা হতো কান্না-সম্রাজ্ঞী। জনশ্রুতি আছে, কান্নার দৃশ্যে নাকি এই অভিনেত্রীর গ্লিসারিনের প্রয়োজন হতো না। সিনেমায় স্ক্রিপ্টের প্রয়োজনে দুঃখ-কষ্টে বুক মাতম করা শাবানার হু-হু কান্নার দৃশ্য থাকবে না তা ভাবাই যেত না। তখনকার দিনে পুরুষ-মহিলা সবাই সিনেমা হলে যেতেন শুধু শাবানার অসাধারণ কান্নার দৃশ্য দেখার জন্য। শাবানা চলচ্চিত্র থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন সেও অনেক দিন হলো। এখন চলচ্চিত্রে আগের মতো কান্নার দৃশ্য থাকলেও তা কেউ শাবানার মতো ফুটিয়ে তুলতে পারেন না।