বাআ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ যাতে শান্তিতে বসবাস করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে সে জন্য দোয়া করতে হজযাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গত শনিবার সকালে রাজধানীর কূর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকার আশকোনা হজ ক্যাম্পে এ বছরের হজ কর্মসূচির উদ্বোধনকালে এই আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা পবিত্র জায়গায় যাচ্ছেন-দোয়া করবেন, যেন এই বাংলাদেশে আমাদের ধর্মে যারা বিশ্বাসী এবং সাথে সাথে অন্য ধর্মে যারা বিশ্বাসী তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে সহঅবস্থান করতে পারে। ধর্মের নামে যারা বিভ্রান্তির পথে যাচ্ছে আল্লাহ যেন তাদের সুপথে আসার পথ করে দেন। আমাদের দেশের মানুষ যেন একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং উন্নয়নের গতিধারাটা যেন আমরা অব্যাহত রাখতে পারি।’
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক সেটাই আমরা চাই। যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে তাদের যেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিচার করার শক্তি দেন এবং তাদের মনমানসিকতাটা যেন পাল্টে দেন। তাদের যেন হেদায়েত করেন- সেটাই আমরা চাই। আমাদের পবিত্র ধর্ম, মানবতার ধর্ম ইসলামের বদনাম যেন কেউ করতে না পারে।
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মে কোথাও বলে না যে কেউ আত্মঘাতি হলেই বেহেশতে চলে যাবে। কিন্তু এই বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমরা চাই না যে আমাদের দেশ কোন বিভ্রান্তির মধ্যে থাকুক।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বজলুল হক হারুন, সৌদি দূতাবাসের ডেপুটি কাউন্সিলর সালেহ আল মুতাইরি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল জলিল অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। পরে দেশ ও জাতির বৃহত্তর ঐক্য ও শান্তি কামনা করে অনুষ্ঠানে বিশেষ মোনজাত অনুষ্ঠিত হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রথম হজ ফ্লাইট ২৪ জুলাই সকালে ৪১৯ জন হজযাত্রী নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায় এবং ২৬ আগষ্ট পর্যন্ত এই হজ ফ্লাইট চলবে। এ বছর বিমান এবং সৌদি এয়ার লাইন্স ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ্জ যাত্রী পরিবহন করবে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার ভাষণের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে দেয়া ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কখনই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেনি বরং সবসময় ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর অবৈধ সেনা শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে বারবার ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনীদের বিচারের পথকে রুদ্ধ করেছে। হাজীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর কেনা জাহাজ হিযবুল বাহারে প্রমোদ ভ্রমণের নামে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিএনপি-জামাত দিনের পর দিন দেশে সহিংসতা চালিয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে পেট্রোল বোমায় ১৬৫ জন নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে আগুন লাগিয়েছে, হাজার হাজার কোরআন শরীফ পুড়িয়েছে। নির্বাচনের দিন ৫৮২টি স্কুল-মাদ্রাসা আগুনে পুড়িয়েছে। ২০১৫ সালেও বিএনপি-জামাত ১৩১ জন মানুষকে হত্যা করেছে। ৩ হাজার ৩৬ মানুষকে আগুনে ঝলসে দিয়েছে। গাড়ির চালক ৫৫ জন পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ট্রেনে আগুন, বাসে আগুন, লঞ্চে আগুন দেয়া আর প্রেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা- এটা কোন ধরনের রাজনীতি আর ধর্ম রক্ষা? প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনও আগুনে ঝলসানো পরিবারগুলোকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, অল্প বয়সীদের লেখাপড়া করানো হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটুক আমরা তা চাই না। তিনিও এ সময়ে বারবার মৃত্যুুর মুখোমুখি হয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আইভি রহমানসহ আমাদের ২২ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। আমার দলের লোকজন এমনভাবে আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন যে আমার গায়ে একটা স্পিন্টার লাগেনি, তাদের গায়ে লেগেছে এবং এই স্পিন্টারে ১ হাজারের মত নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন এবং অনেকেই ধীরে ধীরে মারাও গেছেন। মোহাম্মদ হানিফের (ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র) কথা আপনারা জানেন। তিনি আমাকে সম্পূর্ণভাবে সবসময় ধরে রেখেছিলেন। তখনও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই বাঁচিয়েছেন। হয়তো কোন কাজ তিনি করাতে চান সেইজন্যে। কিন্তুু আমরা চাইনা যে, এ ধরনের ঘটনা আর ঘটুক।
তিনি হাজীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা পবিত্র হজ পালনে পবিত্র মাটিতে যাচ্ছেন। সেখানে আপনারা দোয়া করবেন বাংলাদেশের জন্য। দোয়া করবেন বাংলাদেশের জনগণের জন্য। এ দেশের মানুষের এক সময় এমন অবস্থা ছিল যে, একবেলাও খেতে পারতো না। থাকার একটা ঘর নাই। বিদেশ থেকে পুরানো কাপড়, মানুষের (ব্যবহৃত) পুরাতন কাপড় এনে তাদের পড়তে দেয়া হত। যে কষ্টটা দেখে আমার বাবা সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, এই দুঃখী মানুষের কথা বলেছেন। তাদের কথা যতবার বক্তৃতায় বলতে গিয়েছেন ততবারই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁকে বারবার কারাগারে থাকতে হয়েছে।
তাঁর সরকারের সময়ে হজযাত্রী প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৬ সালে হজযাত্রী ছিলেন ৪৭ হাজার ৯৮৩ জন। এবছর হজযাত্রী হলেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ এবার বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক হজ হজ পালন করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি বার বার হজ পালন করেছেন। সেজন্য হজ ব্যবস্থাপনায় সমস্যাগুলো নিজেই অনুধাবন করেছেন। তাই যখনই সরকার গঠন করেছেন সে সমস্যাগুলো সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছেন। হজ উইং এর অফিস জেদ্দা হতে মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে স্থানান্তর করায় গৃহীত তাঁর সরকারের পদেক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মক্কার হজ মিশনকে শক্তিশালী করেছি।
তিনি বলেন, আমরা ২০১০ সালে গৃহীত জাতীয় হজ নীতিকে আরও যুগোপযোগী ও তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর করে ‘জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতি-২০১৬’ প্রণয়ন করেছি। এই নীতির আলোকেই বর্তমানে হজ ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে এবং আমরাই তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করে ডিজিটাল হজ ব্যবস্থাপনার সূচনা করেছি। হজ বিষয়ক ওয়েব পোর্টালে ক্লিক করলেই আপনারা সকল তথ্য পাচ্ছেন। হজ নিয়ে মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছে। মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমেও প্রত্যাশিত তথ্য পাচ্ছেন।
হজযাত্রীদের রেজিষ্ট্রেশন ডিজিটাইজ করার পাশাপাশি বছরব্যাপী রেজিষ্ট্রেশন সিস্টেম উন্মুক্ত করে প্রাক নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালুর ফলে প্রতারণা বন্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের অধিকাংশ হজযাত্রীরা জেদ্দা হজ টার্মিনালে অবতরণ করে থাকেন। সরকার জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া নিয়েছে। এতে প্রশাসনিক, চিকিৎসা ও আইটি সেবাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে হজ যাত্রীরা সেবা ও সুবিধা পাচ্ছেন।
আগামীতেও হজ ব্যবস্থাপনায় সফলতার ধারা অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি হজ এজেন্সি এবং তাদের সংগঠন হাব (এইচএএবি) কে সুসংগঠিত করা হয়েছে। আমরা হজে অব্যবস্থাপনার অভিযোগে অভিযুক্ত হজ এজেন্সিগুলোকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করেছি। কোন ব্যত্যয় হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। গত সাড়ে আট বছরে আমাদের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে হাজীদের সর্বোচ্চ সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছি।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে হজ ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জোট সরকার হাজীদের দুর্দশা লাঘবে কোন উদ্যোগ নেয়নি। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে প্রথমেই হজ ব্যবস্থাপনায় অতীতের সব অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দূর করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতার শুরুতেই একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ইসলামের কল্যাণে যে অসামান্য অবদান রেখে যান তাঁর একটি খন্ড চিত্র তুলে ধরে তাঁরই আদর্শেও আলোকে দেশ পরিচালনা করছেন বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা মুসলিম বিশ্বসহ আরব দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁর দূরদর্শীতায় বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ওআইসি’র সদস্যপদ লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা নিজে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, কাকরাইল মসজিদের জন্য এবং বিশ্ব ইজতোমার জন্য টঙ্গীতে জয়াগা প্রদান করেন এবং ইজতেমা এদেশে আয়োজনের বন্দোবস্ত করেন। তিনিই প্রথম আইন করে মদ নিষিদ্ধ করেন। ঘোড়দৌড় ও জুয়া বন্ধ করেন। বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের শুরু ও সমাপ্তিতে কুরআন তিলাওয়াতের প্রচলন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে ইসলামের কল্যাণ ও প্রসারে কাজ করেছে। তাঁর সরকারই প্রথম পবিত্র আল কোরআনের ডিজিটাল ভার্সন চালু, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত এবং মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করে। এতে হাজার হাজার আলেম ওলামার কর্মসংস্থান হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।