ফাহাদ বিন হাফিজ॥ মার্কিন মুল্লুকে আপনার কোনো ব্যবসা আটকে গেছে? কিংবা কোনো নতুন আইন বা নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপনার পণ্যের রপ্তানি? ইউরোপের বাজারে আপনি কর অবকাশের জন্য ঘুরছেন? অথবা আফ্রিকায় আপনি ওষুধ রপ্তানি করতে চান? আপনার এসব বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক কাজে সহায়তা দিতে পারে কোনো ‘লবিস্ট’, বাংলায় যাকে বলে তদবিরকারক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে এ ধরনের লবিং আইনসিদ্ধ। অনেক লবিস্ট ফার্ম আছে। অনেক সিনেটর, কংগ্রেসম্যানের মূল পেশা লবিং। তবে এই তালিকায় একজন বাংলাদেশির নাম এখন উজ্জ্বল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল জয়ী। এখন সামাজিক ব্যবসার আন্দোলন করছেন বিশ্বজুড়ে। মার্কিন কংগ্রেসম্যান থেকে স্পেনের রাণী, দক্ষিণ অফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থেকে জার্মান চ্যান্সেলর সবার সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত জানাশোনা। গত বছর ২১১ দিন বিদেশ ঘুরেছেন, প্লেনেই কাটিয়েছেন বছরের ৩৮ দিন। সামাজিক ব্যবসা করলেও তাঁর আয় উপার্জনের প্রধান পথ লবিং করা। বাংলাদেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এফডিএ (ফুড এ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি) সনদ পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করেছেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেদারল্যান্ডের একটি কোম্পানির তেল অনুসন্ধানের কাজ পাইয়ে দিতে তদবিরও তিনি করেছেন।
‘তদবিরকারক’ হিসেবে ড. ইউনুসের নাম প্রথম বাংলাদেশে আসে ২০০৫ সালের এপ্রিলে। ওই সময় বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ড. মুহম্মদ ইউনূসকে লবিস্ট নিযুক্ত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিউটি ফ্রি গার্মেন্টেস পণ্য প্রবেশের অনুমতির জন্য ইউনূসকে ব্যবহার করা হয়। গার্মেন্টস নেতাদের নিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেন, তদবির করেন। হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে তাঁর ব্যাক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের কদর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল ভাবে বেড়ে যায়।
সম্প্রতি বিএনপি দারস্থ হয়েছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সহায়ক সরকারের দাবির পক্ষে প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্যই তাঁকে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। ড. ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত এবং কানাডাকে সহায়ক সরকারের ব্যাপারে উৎসাহী করবেন। ওই দেশগুলো যেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সহায়ক সরকার গঠনে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে। এছাড়াও জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এর মতো প্রতিষ্ঠান গুলোকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সহায়ক সরকারের বিকল্প নেই, এই কথাটি বোঝাবেন।
ড. ইউনূস ইতিমধ্যে হোমওয়ার্ক শুরু করেছেন। আর তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের সঙ্গে দূরত্বের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কাজে ড. ইউনূস বেশ আগ্রহী বলেই জানা গেছে। ড. ইউনূস তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে কেন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা তিনি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরবেন। একই সঙ্গে বর্তমান সংসদ রেখে আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমস্যাগুলো নিয়েও আলোকপাত করবেন। গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফর উল্লাহ এবং অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ গত সপ্তাহে ড. ইউনূসের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকের পরদিনই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলছেন ড. ইউনূস।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন ড. মুহম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগ তাঁকে ১৯৯৭ সালে গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স তুলে দেন। ওই লাইসেন্স প্রদান অনুষ্ঠানে, ড. ইউনূস আওয়ামী লীগের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘এই টেলিকম লাইসেন্স পেতে এক কাপ চা পর্যন্ত সরকারকে খাওয়াতে হয়নি।’ ১৯৯৮ সালের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকূলে ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ড. ইউনূস বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর তিনি এজন্য নিন্দা পর্যন্ত জানাননি। ২০০৬ সালে তিনি এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। নোবেল পুরস্কার জয়ের পরই ড. ইউনুস রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। কিন্তু বিরূপ সমালোচনার কারণে দল গঠন প্রক্রিয়া থেকে তিনি সরে আসেন। দেশে ওয়ান-ইলেভেন আনার ক্ষত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তাঁর ‘শান্তির সন্ধানে’ বইতে উল্লেখ করেছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার জন্য তিনি ড. ইউনূসকে ফোন করেন। কিন্তু ইউনূস তাঁকে জানান, দীর্ঘমেয়াদী সময়ের জন্য তিনিই দেশের দায়িত্ব নিতে চান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তাঁর সঙ্গে সরকারের বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত বয়সের কারণে তাঁকে দেওয়া অব্যাহতির সরকারি আদেশ বৈধ ঘোষণা করে। এরপর ড. ইউনূস হিলারিকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ড. ইউনূসের হাত ছিল বলে আওয়ামী লীগ দাবি করে।