তাজুল ইসলাম নয়ন ॥ তাজুল ইসলাম নয়ন॥ নোবেল পুরস্কার একটি স্বপ্ন এবং এই স্বপ্নকে খুব কম সংখ্যক মানুষই ছুতে পেড়েছেন। কিন্তু আমাদের জনাব ড. ইউনূছ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার এর কারাবন্ধী নেত্রী অং সান সূচী ছুয়েছিলেন ঐ আকাশচুম্বী অমূল্য ধন স্বপ্নের নোবেলকে। কিন্তু সেই ছোয়াই রয়েছে অনেক বিতর্কক ও কলঙ্ক। যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে সম্মান দিয়েছিল এবং সেই সম্মান রক্ষায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছিল তা কিন্তু সবই বৃথায় গেল। কারণ ঐ নোবেলের যোগ্য উত্তরাধীকারী হিসেব তাদের নির্বাচন সঠিক ছিল না। আর ঐ সম্মানের জায়গায় যাওয়ার জন্য ওনারা দুইজনও প্রস্তুত ছিলেন না। বরং জোর করে সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে; স্বার্থ হাসিলের ষোলকলা পূর্ণতার পুরস্কারই বরং গ্রহণ করতে হয়েছিল এই দুই মহারথির। তাদের জীবন ও কর্ম এবং চিন্তা ও এর প্রতিফলন কোনটিই অতিতে শান্তিতে নোবেল পাওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা পূরণ করে নাই বরং সেই নায়ক এবং নায়ীকাই কিনা পেয়েছিল শান্তির পদক নোবেন।
এই নোবেল অর্জনে যেমন তাদের কোন ভূমিকা নেই ঠিক তেমনি রক্ষায়ও কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি এবং নুন্যতম চেষ্টাও করেনি। যা প্রতিয়মান এবং বাস্তবতায় দৃশ্যমান ছিল আছে এবং অদুর ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে। আসলে শান্তির জন্য কাজ করতে শান্তিরাজের শান্তির নিশ্চয়তা এবং অশির্বাদপ্রাপ্ত হতে হয়। সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ এবং মনোনয়ন ছাড়া কেউ..ই এই কাজ করতে পারে না। সেই দৃষ্টান্ত থেকে এই দুই মহারথি নিজ স্বার্থ যা ব্যবসা ও রাজনীতি কেন্দ্রীক; তাই করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। কিন্তু শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে কোন মাথাব্যথা তাদের নেই। মনে হয় এরা এতই উদাসীন যে, তাঁরা এখন পৃথীবিতে নেই বরং তাঁরা স্বর্গে অবস্থান করছেন। আর পৃথিবীর খোজ খবর রাখার সময় এখন তাদের নেই। স্বর্গের কাজ শেষ করে তাঁর ফিরে আসবেন মর্তে শুধু দুধের স্বর খাওয়ার আশায়। দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, কৃষক, গাভী এবং দেশ কোন কিছুই যেন না পায় সেই ব্যবস্থা করেই তারা নামবেন এই মর্তে দুধ ও স্বর আস্বাধনের লক্ষ্যে।
আসা যাক আমাদের ড. ইউনূছ সাহেবের প্রসঙ্গে, ওনি নোবেল পেয়ে কি করেছিলেন জানেনতো সবাই.. তাই না? তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধান হতে যেমনি করে হয়েছিলেন খুনী জিয়া। কিন্তু বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাই তিনি সাহস করে সিংহাসনে আরোহন করেননি। কারন তিনি স্বর খাওয়া স্বর্গের উর্ধ্বে উঠা মানুষ। জাতির ক্রান্তিকালে তিনি দেশে থাকেন না এমনকি কোন ভুমিকা রাখেন না বরং বিরাজমান সমস্যা আরো বাড়িয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন। দেশে জালাও ও পোড়াও রাজনীতি এবং জনগণের জান, মাল এবং নিশ্চয়তা সবই যখন শেষ হয়ে যাচ্ছিল তখনও তিনি আগুলে পানি ডালতে আসেননি বরং আগুনে ঘী ঢেলে আরো প্রজ্জলিতই করেছিলেন বটে। এই কি তার শান্তির নোবেল এর মর্যাদার নমুনা। অপরদিকে যখন বাংলার মানুষ বণ্যা, খড়া, সাইক্লোনসহ নানাহ প্রাকৃতিক দুর্য়োগে হাবুডুবু খাচ্ছিল তখন তিনি কিনা টাকা দান করলেন ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে এবং হিলারী ক্লিনটনকে নির্বাচনে জিতাতে দেশী এবং বিদেশে লবিং এমনকি গুরুত্বপূর্ণ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই কি তার নোবেল এর নমুনা। যখন একটি নির্বাচিত সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এমনকি উন্নত বিশ্বের কাতাড়ে দাঁড় করাতে সংগ্রামরত সেই সরকারকে ক্ষমতাচুত্য করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ঐ নোবেলধারী। এটাইকি নোবেল অর্জন এবং রক্ষা করার বৈশিষ্ট্য। আর তাহ যদি হয় তাহলে ওনারা ঠিক আছেন আর আমরা আম জনতা ভুল বুঝে এবং ব্যাখায় নোবেল নিয়ে লাফালাফি করি মাত্র। তবে এই দুইজন ব্যতিত বাকি যারা বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল অর্জন করেছিলেন তাদের জীবন আচরণ এবং কর্মের মধ্যে যে ফারাক পেয়েছি তা কিন্তু নোবেল পুরস্কার এর মান বৃদ্ধি করতে সহায়ক ছিল। আর ঐ জন্য পৃথিবীর আম জনতা নোবেলকে সম্মান জানায় এবং এর স্বপ্ন ছুয়ে যেতে চাই।
এবার আসা যাক আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার এর দিকে; আর ঐ দেশেরই একজন পেয়েছিল নোবেল এবং শান্তিতে নোবেলকে করেছে রক্ষে ক্ষত-বিক্ষত। তা সারা নেট দুনিয়া ঘুরে এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জেনে নিম্নে উল্লেখ করলাম।
নেট দুনিয়ায় নানা ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এই ঘুরে বেড়ানো নতুন কিছু নয়। কারোরই রেহাই মেলেনি। গর্ভবতী মা। মাতৃগর্ভের শিশু। গুলি খাও, না হয় আগুনে পুড়ে মরো। ধর্ষণ যেন মামুলি ব্যাপার। বাঁচতে চাইলে পালাও। এবার অবশ্য পালাতে গেলেও গুলির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই লেখা শুরুর সঙ্গেই সঙ্গেই নজরে এলো হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট। স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে ধরা পড়েছে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার চিহ্ন। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এক শ’ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একই দৃশ্য। গত বছরও গ্রামের পর গ্রামে আগুন দিয়েছিল সরকারি বাহিনী। এবারের ঘটনা আরো ভয়াবহ।
মানবাধিকার শব্দ নিয়ে অনেক বাকওয়াজ। এটা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। যদিও দুনিয়ায় এর বেঁচে থাকা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। মিয়ানমারের দৃশ্যপটের দিকে তাকালে সে সন্দেহ অবশ্য অনেকটা কেটে যায়। নাফ নদে শুধু জীবিত, মৃত মানুষই ঘুরে বেড়াচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানবতা। তবে এই দৃশ্য এর চেয়েও বেশি মৃত্যু ঘোষণা করেছে এক নারীকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কারের। দুই যুগের কিছু বেশি সময় আগে অং সান সুচিকে যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তখন দৃশ্যপট কেমনই না ছিল। সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ, পরে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের জন্য বিরামহীন লড়াই। কত যন্ত্রণা আর নিপীড়নই না সইতে হয়েছে তাকে। নিজ ঘরে বন্দি ছিলেন দিনের পর দিন। কেড়ে নেয়া হয়েছিল তার সব অধিকার। সেসময় সুচির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল সারা দুনিয়া। সোচ্চার ছিলাম আমরাও। নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের।
এ পুরস্কারে রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে তাও অনেকদিন হলো। কিন্তু সুচির নোবেল নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন তখনই ওঠেনি। কিন্তু হায় ক্ষমতা। ক্ষমতায় যাওয়ার পরই বদলে গেলেন শান্তি কন্যা। দেখা গেলো তার নতুন রূপ। ভয়ঙ্কর। তার সরকারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন যে তিনি শুধু চোখ বুজে দেখলেন তাই নয়। তিনি তা অনুমোদন করলেন প্রকাশ্যে। তিনি মুখ খুললেন। তার এই মুখ খোলা হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। মানবতাবাদী মানুষ ধিক্কার জানালেন তাকে। কিন্তু তাতে কী? তার চাই রক্ত আর ক্ষমতা। হাতে রক্তের দাগ নিয়ে তিনি বললেন, রোহিঙ্গারাই রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। সেখানে কোনো জাতিগত নিধন হয়নি। মুনীর চৌধুরী লিখে গেছেন, মানুষ মরে গেলে পচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়। কিন্তু কেউ কেউ যে, বেঁচে থেকেও পচে যায় অং সান সুচি তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
গত বছরই দাবিটি উঠেছিল। হাজার হাজার মানুষ সই করেছিলেন সেই দাবিতে। নোবেল কমিটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল অং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরস্কার যেন প্রত্যাহার করা হয়। কারণ তার এই পুরস্কার শান্তিকামী মানুষের জন্য অবমাননা। সে দাবির প্রতি এখনো পর্যন্ত সাড়া দেয়নি নোবেল কমিটি। হয়তোবা এর কোনো নজির নেই বলেই তারা নীরবতা পালন করছেন। কিন্তু পৃথিবীতে নজিরবিহীন অনেক ঘটনাই ঘটছে। অং সান সুচি যে এতটা বদলে গেছেন তা কি নজিরবিহীন নয়। মানবাধিকারের প্রতি, মানুষের প্রতি যে বর্বর আচরণ তার, তা শুধু তাকে নয়, লজ্জায় ফেলেছে নোবেল শান্তি পুরস্কারটিকেও। বিতর্ক সত্ত্বেও এ পুরস্কারের যেটুকু মর্যাদা রয়েছে তাও কলঙ্কিত হচ্ছে সুচির কারণে। তার হাতে এ পুরস্কার বড্ড বেমানান। সুচির কাছ থেকে এই পুরস্কার কেড়ে নেয়া প্রয়োজন। সেটা শুধু পুরস্কারটির মর্যাদা রক্ষার জন্যই নয়, বরং যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন বা ভবিষ্যতে যারা পাবেন তারা যেন মানবতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করার আগে অন্তত ভাবেন সেজন্য হলেও এ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়ানো ছবির কথা আগেই বলেছি। বহু ছবি। হত্যা, ধর্ষণের শিকার লাশের বীভৎস ছবি। আহত মানুষের আর্তনাদ। ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিহত শিশুর লাশের ছবি। আশ্রয়ের খোঁজে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে মানুষ। যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়, তারা কি নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। মিয়ানমারের কথিত গণতন্ত্রের নেত্রীর ওপর তারা কি কোনো চাপ প্রয়োগ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। নির্যাতিতদের ধর্ম পরিচয় কী মুখ্য হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ অবশ্য সার্টিফিকেট দিয়েই তাদের কাজ অনেকটা সেরেছে।
রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি এ সার্টিফিকেট দেয়া কম কিসে। আনান কমিশনও কিছু সুপারিশ করেছে। সুপারিশেই সার। কিন্তু পরিস্থিতি কিছুই বদলায় নি। সুপারিশের পরপরই উপলক্ষকে উসিলা বানিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের পথই বেঁচে নিয়েছে তারা। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোও পরিচয় দিয়েছে নিদারুণ ব্যর্থতার। তাদের সব সামরিক জোট যেন কেবল নিজ স্বার্থ রক্ষায়। আর এসব দেশের নেতাদের বেশি আনাগোনা অবকাশ কেন্দ্রে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা থাকুক নদীতে। আর বিশ্ব নেতারা থাকুক অবকাশ কেন্দ্রে। এ এক চমৎকার দৃশ্য।
এই দৃশ্ব্যেও অবতারনায় আজ আন্তর্জাতিক দুটি নোবেল পদক এর মৃত্যু ঘটল। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শব্দটিরও মৃত্যু ঘটলো।