তাজুল ইসলাম নয়ন॥ আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। এ ক্ষেত্রে হালের রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে চান তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর কর্নেল (অব:) ফারুক খান ও ডা: দীপু মনির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাচ্ছেন। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আগামী মাসে ভারত সফরে যাচ্ছেন আরেকটি প্রতিনিধিদল। এ ছাড়া এ মাসেই ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছেন। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ওই প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করবেন বলে দলের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্রগুলো জানায়, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল ও নির্বাচনী মাঠ গোছানোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনেতিক সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে বিএনপি জোটবিহীন ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের কারণে সৃষ্ট দূরত্ব ঘোচাতে চান তারা। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে একটি বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে মনে করা হচ্ছেÑ যা ইতোমধ্যেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে গেছেন দলটির আরো পাঁচ নেতা। তারা হলেনÑ দলে দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুনুর রশীদ, সদস্য এস এম কামাল হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও ইকবাল হোসেন অপু। আগামী ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বৈঠক করবেন। আর এসব বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মানবিক পদক্ষেপ তুলে ধরবেন তিনি। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে জোরালো সমর্থন চাইবেন তিনি।
১৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের ১৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বেইজিং যাচ্ছে। সেখানে তারা ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকবেন। এ সফরে তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথে বৈঠক করবেন। ১৯ সদস্যের এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব:) ফারুক খান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনি।
এ প্রতিনিধিদলে আরো থাকছেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, শিল্পবিষয়ক সম্পাদক শামসুর নাহার চাপা, উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার, পারভীন জাহান কল্পনা, অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাওসার, মেরিন জাহান, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং।
চীন সফরের জন্য মনোনীত প্রতিনিধিদলের সাথে গতকাল বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে প্রতিনিধিদলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন তিনি। বৈঠকে পরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে বাংলাদেশ এখনো পাশে পায়নি, চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওবাদুল কাদের বলেন, যে বিষয়ে আলোচনা জাতিসঙ্ঘে হচ্ছে সেই আলোচনা তো এখানে অবশ্যই আসবে। আর চীন বিষয়টি অস্বীকারও করেনি। যার প্রমাণ হলো জাতিসঙ্ঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বসম্মত বিবৃতি দিয়েছে।
রাশিয়া এ ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, রাশিয়ার বিবৃতি নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। রাশিয়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। আমি আমার দেশের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ চাইবো?
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আজকেও প্রধানমন্ত্রী জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে যোগ দেয়ার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকেছেন। তিনি সবাইকে নিয়ে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেছেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে আগামী মাসে ভারত সফরে যাবে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আট সদস্যের এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন।
জানা গেছে, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর পক্ষে এ আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক রাম মাধব। আমন্ত্রণপত্র ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের হাতে এসে পৌঁছেছে। তবে সফরের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ইতিমধ্যেই জানা গেছে প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা এইচ টি ইমান এখন ভারতে রয়েছেন। আরো জানাগেছে এর বাইরেও দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বর্তমানে বেলজিয়ামে অবস্থান করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আলাপকালে বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সাথে আন্তর্জাতিক মহলের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।
সরকার সেই বিষয়টি কাটিয়ে ওঠার জন্য নানা মাধ্যমে চেষ্টা করে আসছিল। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল সরকার। যাতে আওয়ামী লীগের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন থাকে। ঠিক সেই সময়ই রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে এসে পড়েছে। প্রথম দিকে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে সরকার নেতিবাচক হিসেবে দেখলেও ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। সে জন্য শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা হলেও এখন আর করা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি পেতে চায় সরকার। ইতোমধ্যেই সেই লক্ষ্য খানিকটা অর্জিতও হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের দু’জন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে তুরস্কসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেই সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে বাংলাদেশে সফরে এসে বর্তমান সরকারের প্রশংসা করেছেন। তুরস্কের রাষ্ট্রপতিও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সাথে ফোনে আলাপ করে পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া পুরো মুসলিম বিশ্ব ত্রাণতৎপরতা ছাড়াও এখন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশও সরকারের পাশে রয়েছে। শুরুর দিকে প্রতিবেশী ভারত মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিলেও পুরো বিশ্বের সমালোচনার মুখে তারা এখন বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। তারা ইতোমধ্যে দুই দফায় ত্রাণও পাঠিয়েছে। এককথায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে দু-একটি দেশ ছাড়া প্রায় পুরো বিশ্ব শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনাকে মানবিক নেত্রী হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন কেউ কেউ। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় সরকার। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ সমর্থন ধরে রাখতে চান সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। সে জন্য বিদেশ সফর ও নিয়মিত যোগাযোগসহ নানা ধরনের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে একটি আত্ম-মর্যাদাশীল ও মানবিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশ বা সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের নির্যাতিত ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে আজ মানবিক নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার নেতৃত্ব ও মানবিকতার প্রশংসায় আজ পুরো বিশ্ব পঞ্চমুখ। আন্তর্জাতিকভাবে এ ইমেজ আমরা আগামীতেও ধরে রাখতে চাই। তবে নির্বাচন হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের কোনো হস্তক্ষেপ আমরা কখনো কামনা করিনি এবং ভবিষ্যতেও করব না।
দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বলেন, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের যে সুসম্পর্ক আছে, এই সফরগুলো তারই প্রমাণ। এসব সফরে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ও রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরা হবে।