তাজুল ইসলাম নয়ন॥ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। প্রধান বিচারপতির এক মাস ছুটিতে যাওয়ার সঙ্গে যারা ওই রায়কে এক করে দেখছেন, তাদের বক্তব্যে ‘দুরভিসন্ধি’ও দেখেছেন তিনি।
গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর সাথে এটার কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয় নাই। ছুটি শেষেই বিচারপতি সিনহা কর্মস্থলে ফিরবেন- এমন আশা প্রকাশ করে সেজন্য দোয়া করার কথাও বলেছেন আনিসুল হক।
অগাস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। এর মধ্যে তিনি মঙ্গলবার থেকে এক মাসের ছুটিতে যাওয়ায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা অভিযোগ তুলেছে- চাপ দিয়ে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে প্রধান বিচারপতিকে।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সংসদ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। রায় বদল এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরে পর্যবেক্ষণ দেওয়া বা সমালোচনা করা আমাদের অধিকার। আমরা সংক্ষুব্ধ পার্টি হিসেবে এই রায়ের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেব, জাতীয় সংসদে সেটা প্রস্তাব আকারে পাস হয়েছে। সেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেটা পাস হয়েছে। সেই কারণে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিশ্চয়ই নেব, তার সাথে মাননীয় প্রধান বিচারপতির অসুস্থতার কোনো নেক্সাস নাই। এর সাথে যদি কেউ কানেক্ট করতে চায় তো আমি মনে করব তাদের একটা দুরভিসন্ধি আছে।
চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে- বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানাতে চান এক সাংবাদিক। জবাবে আনিসুল হক বলেন, উনাদের এই বক্তব্য ভিত্তিহীন, এটার কোনো প্রমাণ নাই। সো এইসব ইউজলেস কথাবার্তার জবাব আমার দেওয়ার দরকার নাই। এক মাসের ছুটি শেষে তিনি কর্মস্থলে ফিরে আসবেন এটা আমি আশা করি ও দোয়া করি।
আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শেষে মঙ্গলবার আদালত খুললে প্রধান বিচারপতির অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার আগেই সোমবার বিচারপতি সিনহার ছুটিতে যাওয়ার খবর আসে।
পরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কথা জানিয়ে ৩ অক্টোবর থেকে এক মাসের ছুটি চাওয়ায় রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেছেন। আর এই সময়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেওয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী গত মঙ্গলবার সকালে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। অন্যদিকে বিএনপিপন্থিদের নেতৃত্বে থাকা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ‘জরুরি সভা’ করে সরকারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আনে।
সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্টের রীতি অনুযায়ী আইনজীবীরা যেন ‘গেট টুগেদারে’ আসেন, সে বিষয়ে আগেই চিঠি দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। কিন্তু তিনি নিজেই ছুটিতে গেছেন বলা হচ্ছে।
ইতিহাস বলে, কখনও কোনো প্রধান বিচারপতি দাওয়াত করে এভাবে ছুটি নিয়ে চলে যান নাই। আমাদের সেটা জানার দরকার আছে। তার ওই বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, উনারা বলে দিলেন এটা নজিরবিহীন। মানুষ অসুস্থও হতে পারবে না? এর আগে যেহেতু কেউ হয় নাই, এখনও কেউ অসুস্থ হতে পারবে না! এ রকম কথা যদি উনারা বলে থাকেন, উনাদের অবাস্তব কথার জবাব দেওয়ার জন্য আমি এখানে বসি নাই।
প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আনিসুল হক বলেন, “তিনি তার পত্রে লিখেছেন, তিনি ক্যান্সার এবং নানাবিধ রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং সেগুলো সম্পূর্ণ যেহেতু সারে নাই এবং উনি বলেছেন যে উনার আরও বিশ্রামের প্রয়োজন, সেজন্য উনি এক মাসের ছুটি নিয়েছেন।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি আমাদেরকে জানিয়েছেন, আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বিশ্বাস করি এবং তিনি বলেছেন তিনি অসুস্থ। এর উপরে আমি কোনো প্রশ্ন করতে রাজি না। তিনি যেভাবে আমাদেরকে বলেছেন, ঠিক সেইভাবে আমরা যেহেতু সুপ্রিম কোর্টটা চলতে হবে এবং সংবিধানে যে প্রভিশনস আছে সে অনুযায়ী এখন একজন চিফ জাস্টিস থাকবে।
বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধান বিচারপতির ছুটি নেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কেও সাংবাদিকদের বলেন আইনমন্ত্রী।
এখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিজের ছুটি নিজে নেন, এটা কারো কাছ থেকে অ্যাপ্রুভ করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যেহেতু তিনি ছুটিতে যাবেন এবং ছুটিতে থাকাকালে আরেকজন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন, সেই কারণে তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবগত করেন ছুটির ব্যাপারে।
ঠিক সেই রকমভাবে, এই যে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়, সেই পত্র আমাদের এখান থেকে এই আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রক্রিয়া হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তরে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে ৯৭ অনুচ্ছেদে যেহেতু বলা আছে যে প্রধান বিচারপতি অসুস্থ বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে আপিল বিভাগের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব অস্থায়ীভাবে পালন করবেন।
সেই নিয়ম অনুসারেই একজন বিচারককে অস্থায়ীভাবে দায়িত্বভার দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং এ নিয়ে ‘স্পেকুলেশনের’ কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন আনিসুল হক। তিনি বলেন, এ নিয়ে উনরা স্পেকুলেট কেন করছেন? আমি একটু স্পেকুলেট করি?… আমার মনে হয় যে উনারা কিছু একটা ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছিলেন। এই যে গণতন্ত্রের ধারবাহিকতা, যেটা ছিল, সেটা ব্যাহত বা নস্যাৎ করার চেষ্টা বোধহয় উনারা করছিলেন। এখন সেই চেষ্টাটা বোধহয় সফল হবে না, সেজন্য উনারা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন।
ষোড়শ সংশোধনীর রায় এখনও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে।