আবুদল আখের॥ সাবেক সেনাপ্রধান এবং ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নতুন বই প্রকাশিত হবে আগামী ফেব্রুয়ারীতে। ক্যান্সারে আক্রান্ত সাবেক এই সেনাপ্রধান এখন নিউইয়র্কে নিভৃত জীবন যাপন করছেন। ২০০৯ সালের জুন থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ২০১০ সালে জেনারেল মঈন আহমেদের ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসা নিয়ে তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ। অখন্ড অবসরে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে বই লিখেছেন। ইংরেজীতে লেখা এই বইয়ের পান্ডুলিপি ‘পেংগুইন র্যানডম’ প্রকাশনায় জমা দিয়েছেন। বর্তমানে বইটির সম্পাদনার কাজ চলছে।
খসড়া পান্ডুলিপিতে মঈন ইউ আহমেদ ‘শেখ হাসিনাকে ‘বিচক্ষণ, দেশপ্রেমিক এবং রাষ্ট্রনায়োকচিত গুণাবলী সম্পন্ন রাজনীতিবীদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিক বেগম জিয়াকে ‘পরিবার কেন্দ্রিক, অস্থির এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।’
এটা মঈন ইউ আহমেদের দ্বিতীয় গ্রন্থ। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘শান্তির স্বপ্নে, সময়ের স্মৃতি চারণ’ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ গ্রন্থটি আত্মজীবনী মূলক হলেও, প্রকাশিতব্য গ্রন্থটি বিশ্লেষন মূলক। এখানে ওয়ান-ইলেভেনের ব্যর্থতা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন। খসড়া পান্ডুলিপিতে তিনি সুশীল সমাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর পান্ডুলিপিতে জেনারেল লিখেছেন ‘আমাদের সুশীল সমাজ ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর এবং জনবিচ্ছিন্ন।’
জেনারেল তাঁর গ্রন্থ শুরু করেছেন, নিজের একাকীত্ব এবং প্রবাসজীবনের কষ্ট দিয়ে। তিনি লিখেছেন ‘ইচ্ছা ছিলো যে সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণের পর দেশের জন্য কাজ করবো। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করবো। কিন্তু প্রতিহিংসা পরায়ন রাজনীতির কারণে আমি দূর দেশে। অসুস্থ হয়ে বিদেশে জীবন যাপন যে কতটা কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।’ গ্রন্থে দীর্ঘ ২১ পৃষ্ঠা তিনি নিজের সাফাই গেয়েছেন এবং তিনি কি কি ভালো কাজ করেছেন, সে সম্পর্কে বলেছেন।
খসড়া পান্ডুলিপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলেছেন। মঈন ইউ আহমেদ বলেন ‘দেশে শক্তিশালী এবং ক্রিয়াশীল একটি সুশীল সমাজ দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে তাদের রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানোর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। এই সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রনে ছিলো দেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক। তাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা এবং আমার অন্তত তিন দফা বৈঠকে তারা বার বার দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে, রাজনীতি থেকে (দুই নেত্রীকে) বিদায় করতে বলেন।’ তিনি লিখেছেন ‘সুশীলদের দুষ্ট ফাঁদে পা দেয়াটা ছিলো সেনাপ্রধান হিসেবে আমার ভুল সিদ্ধান্ত। পরবর্তীতে দেখলাম, এরা শুধু নিজের স্বার্থই বোঝেন, জনগণের কথা কিছুই ভাবেন না। এরা অত্যন্ত লোভী, পদ-পদবী এবং নানা সুযোগ সুবিধার জন্য এদের নিয়মিত তদবির আমার মোহ ভঙ্গ ঘটায়।’…
দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে মঈন ইউ আহমদ বলেন ‘শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার কোন যৌক্তিক এবং আইনগত কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বেগম জিয়াকে একক ভাবে গ্রেপ্তার করা সম্ভব ছিলো না। তখন আমরা পুরনো কিছু মামলা দিয়ে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করি। কিন্তু বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আমরা সুস্পষ্ট দূর্নীতির অভিযোগ পাই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যেকোন বিচারেই মামলা যোগ্য ছিলো।’
মঈন ইউ আহমেদ তাঁর খসড়া পান্ডুলিপিতে বলেছেন ‘খালেদা জিয়া রাজনীতি ছেড়ে বিদেশে যেতে সম্মত ছিলেন। তাঁর কাছে তার দুই সন্তানের নিরাপত্তাই মুখ্য ছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজনীতি ছেড়ে বিদেশে যেতে অস্বীকৃতি জানান। মূলত: শেখ হাসিনা একাই দাবার ছক উল্টে দেন।’ তিনি লিখেছেন ‘এখন বুঝি সুশীল সমাজ কেন তার ( শেখ হাসিনার) উপর ক্ষুদ্ধ ছিলো। আদর্শের এবং নীতির প্রশ্নে তাকে টলানো অসম্ভব।’ শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে তিনি বলেছেন ‘আমি সৌভাগ্যবান, আমি বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দুজনের অধিনেই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছি। দুজনের পার্থক্য, দেশ পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে বইয়ে দীর্ঘ আলোকপাত করা হয়েছে। দুজনের পার্থক্য করতে যেয়ে সাবেক সেনাপ্রধান বলেছেন ‘শেখ হাসিনা বিচক্ষণ, দেশ প্রেমিক। দেশের প্রশ্নে তিনি অটল।’ অন্যদিকে বেগম জিয়াকে সাবেক সেনাপ্রধান অস্থির পরিবার কেন্দ্রিক এবং প্রতিহিংসা পরায়ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জেনারেল তার পান্ডুলিপিতে লিখেছেন ‘দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহনের এক আশ্চর্য ক্ষমতা শেখ হাসিনার আছে। অন্যদিকে বেগম জিয়া সিদ্ধান্ত দিতে কালক্ষেপনের নীতি গ্রহন করতেন।’ এপ্রসঙ্গে জেনারেল বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। খসড়া পান্ডুলিপিতে মঈন ইউ আহমেদ বলেন ‘ বেগম জিয়ার প্রধান সমস্যা হলো তার ছেলে তারেক জিয়া।’ বেগম জিয়ার প্রতিহিংসা পরায়নতাই তার দেশ ত্যাগের প্রধান কারণ বলে গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মঈন ইউ আহমেদ তার খসড়া গ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি এবং দূর্বৃত্তায়নকে উন্নয়নের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।