নোশিন তাহসিন আরীব॥ হঠাৎ করেই মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট তিনটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো। বেগম জিয়া বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। আইন অনুযায়ী, জামিন পেতে হলে, হয় উক্ত আদালতে তাঁর আইনজীবীদের আপিল করতে হবে অথবা স্বশরীরে নিম্ন আদালতে অত্মসমর্পন করে জামিন নিতে হবে। না হলে ফিরলেই বিমানবন্দরেই তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হবে। অন্যদিকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৩, ২৪ ও ২৫ অক্টোবর মামলার যুক্তিতর্কের দিন নির্ধারণ হয়েছে। এরপর রায় ঘোষিত হবে। এই মামলার অন্যতম প্রধান আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেছেন, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণে আমরা তারেক জিয়ার সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি।
আমরা আশা করি, তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’ এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। জিয়া পরিবারের নিয়ন্ত্রক দুইজনের জেল ও ফাঁসি ভাবনায় বিএনপি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘জামাতকে যেভাবে পঙ্গু করা হয়েছে, সেই একই ভাবে বিএনপিকেও পঙ্গু করার পথে এগুচ্ছে সরকার।’ অবশ্য আওয়ামী লীগ এ ধরনের অভিযোগ খন্ডন করেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিষয়গুলো আইনগত, রাজনৈতিক নয়।’
বেগম জিয়ার উপর্যুপরি তিনটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার দুটি পৃথক আদালত বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়া আদালতে হাজির না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, মানচিত্র ও জাতীয় পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে গত বছরের এক মানহানি মামলায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকা মহানগর হাকিম। এর আগে গত ৯ অক্টোবর পেট্রোল বোমার এক মামলায় কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালত বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। উচ্চ আদালতে জামিন না হলে দেশে ফিরলেই জেলে যেতে হবে বেগম জিয়াকে। সরকার এখন এব্যাপারে কঠোর অবস্থানে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, ‘মামলা এড়ানোর জন্যই বেগম জিয়া লন্ডনে বসে আছেন। তিনি বিচার আদালত কিছুই মানছেন না, এটা চলতে পারে না।’ বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে যদি উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়, তাহলে সরকার পক্ষ তার বিরোধীতা করবে। সরকার পক্ষের একজন আইনজীবী বলেছেন, ‘ মামলার একজন আসামি বিদেশে গেলে তাঁকে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু জিয়া অরফানেজ মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়া আদালতের অনুমতি না নিয়েই গেছেন।’ এছাড়াও সমস্যা আছে, উচ্চতর আদালতে বেগম জিয়ার জামিন আবেদন করলেই তাঁকে মেডিকেল রিপোর্ট দিতে হবে, স্বাস্থ্যের সবশেষ অবস্থার ডাক্তারি রিপোর্ট দিতে হবে। জানাতে হবে তাঁর ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ। কিন্তু বিএনপির আইনজীবীরা এসব ব্যাপারে অন্ধকারে। জিয়ার অরফানেজ মামলায় বেগম জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার জুলাই মাসে তিন সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন। এখন বিএনপির কেউই জানে না, বেগম জিয়া কবে ফিরবেন। তাই উচ্চতর আদালতে জামিন পাওয়া সহজ নাও হতে পারে। বিএনপির অনেক নেতাই এখন চিন্তিত। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আতঙ্কে শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়া লন্ডনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেন কিনা। আবার সাহস করে দেশে ফিরলে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে, তা প্রতিরোধের সামর্থ্য ও শক্তি বিএনপির আছে কিনা, সে ভাবনাতেও উদ্বিগ্ন বিএনপি। বিএনপির একজন নেতা বললেন, ‘ম্যাডাম, লন্ডনে থাকলে আমরা তাও গলা ফাঁটিয়ে বক্তৃতা দিতে পারব, কিন্তু তাঁকে যদি গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে তো আমরা ঘর থেকেই বেরুতে পারব না।’ এরকম দ্বিধা-দ্বন্ধ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়া কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখার বিষয়।
বেগম জিয়ার চেয়েও বিএনপির নেতারা উদ্বিগ্ন তাঁদের দ্বিতীয় নেতা তারেক জিয়াকে নিয়ে। নভেম্বরের মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় দেবে। এই মামলায় যদি তারেক জিয়া দন্ডিত হন, তাহলে তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের অধিকার হারাবেন। ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী,‘কেউ যদি আদালত কতৃক সন্ত্রাসবাদে দন্ডিত হন বা কারও বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের অধিকার হরাবেন। এই মামলা তাই বিএনপিকে অস্তীত্বের সংকটে নিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ। আর দন্ডিত হলে তাঁকে আত্মসমর্পন করেই আপিল করতে হবে। এরকম পস্থিতিতে তারেক জিয়া কী করবেন-তা বিএনপির মাথাব্যাথার এক বড় কারণ।
দলের দুই শীর্ষ নেতা যদি এরকম অবস্থায় পতিত হয় তাহলে নেতৃত্বহীন বিএনপি কী করে, সেটাই দেখার বিষয়।