টিআইএন॥ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা এক মাসের ছুটিতে যাওয়া নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের চাপের মুখে প্রধান বিচারপতিকে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি (প্রধান বিচারপতি) এখন সরকারের কাঠগড়ায়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ নাকচ করে দেয়া হচ্ছে।
কী ছিল প্রধান বিচারপতির ছুটি নেয়া সেই চিঠিতে? বুধবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরলেন এসকে সিনহার সেই চিঠি। রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রধান বিচারপতির লেখা চিঠির ‘বিষয়’ এ লেখা হয়েছে ‘অসুস্থতাজনিত কারণে ৩ অক্টোবর ২০১৭ খ্রি: হতে ১ নভেম্বর ২০১৭ র্খ্রি: তারিখ পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটির আবেদন।’
এরপর লেখা হয়েছে, ‘মহাত্মন, আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি গত বেশ কিছুদিন যাবত নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় ভুগছি। আমি ইতোপূর্বে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময় চিকিৎসাধীন ছিলাম। বর্তমানে আমি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছি। আমার শারীরিক সুস্থতার জন্য বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন। ফলে আমি আগামী ৩ অক্টোবর ২০১৭ খ্রি: হতে ১ নভেম্বর ২০১৭ খ্রি: তারিখ পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি ভোগ করতে ইচ্ছুক।’
আরও লেখা হয়েছে, ‘এমতাবস্থায় আগামী ৩ অক্টোবর ২০১৭ খ্রি: হতে ১ নভেম্বর ২০১৭ খ্রি: তারিখ পর্যন্ত ৩০ (ত্রিশ) দিনের ছুটির বিষয়ে মহাত্মনের সানুগ্রহ অনুমোদন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।’
চিঠির নিচে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্বাক্ষর রয়েছে। আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের পুরো চিঠিটি পড়েও শোনান।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তার আবেদন পত্রে রয়েছে ভুল। লেখা হয়েছে অমি (হবে আমি)। আবার লেখা হয়েছে ‘অক্রান্ত’। হবে আক্রান্ত। বিএনপির কল্পিত ‘আর্মির ক্যু’তে প্রধান বিচারপতির চেয়ারচ্যুতি
আর্মি জেনারেলদের ব্যবহার করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বাবুকে জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানোর অজানা কাহিনি প্রচার করছে বিএনপি। বিএনপি দাবি করছে, খুব ঘনিষ্ঠ সোর্স থেকে ভেতরের আসল এবং ১০০% সত্য খবর। মাত্র কয়েক মিনিটের অপারেশনে সিনহা বাবু কুপোকাত।
শরৎকালীন ভ্যাকেশন শেষ হলো। অনেকদিন পর কোর্টের কার্য্যক্রম শুরু হলো। সিনহা বাবু সোমবার (৪ অক্টোবর) সকালে সুপ্রীম কোর্টে এলেন। একটি অনুষ্ঠানের ভেন্যুও ভিজিট করলেন। ভিজিট শেষে নিজ অফিসে বসলেন। এমন সময় সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আওয়ামী কিছু সিনিয়র আইনজীবির গোপন সহযোগিতায় সিভিল ড্রেসে প্রধান বিচারপতির অফিস রুমে ঢুকলেন কয়েকজন আর্মি জেনারেল।
উল্লেখ্য, এই আর্মি জেনারেলরা রাতের অন্ধকারে সুপ্রীম কোর্টে ভবনে ঢুকেছিলেন এবং তারা প্রধান বিচারপতির অফিসের পাশের একটি রুমে আত্মগোপনে ছিলেন। আর্মির এই আওয়ামী জেনারেলরা রুমে ঢুকেই কোমর থেকে অস্ত্র বের করে সিনহা বাবুর বুকের দিকে তাক করে বলে, ‘এই কাগজে স্বাক্ষর করো।’ পদত্যাগপত্র একটা ওরা রেডি করে নিয়ে গিয়েছিলো। সেটাতেই ভয়ে স্বাক্ষর করলেন সিনহা বাবু। স্বাক্ষর শেষ হলে প্রধান বিচারপতির অফিসের পাশে বিল্ডিং-এর নীচে রাখা গাড়িতে এনে জোরপূর্বক উঠিয়ে উনাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় আর্মি জেনারেলরা। এরপর তাকে তার বাসায় কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কার্যত গৃহবন্দি সিনহা বাবুর সাথে কেউ কথা বলতে পারছেন না।
শরৎকালীন ভ্যাকেশন শেষে সাধারণত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন প্রধান বিচারপতি। কিন্তু সে সুযোগও পাননি ওইদিন তিনি। এর আগেই তাকে কোর্ট এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। অথচ সিনহা বাবু আগেই চিঠি দিয়ে সোমবারের গেট টুগেদারে আইনজীবিদের উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইতিহাস বলে, কখনও কোনো প্রধান বিচারপতি দাওয়াত করে এভাবে ছুটি নিয়ে চলে যান নাই।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম একবার আইনজীবিদের এভাবে দাওয়াত করে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না, স্ট্রেচারে করে এসে আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আর সিনহা বাবু সেই গেট টুগেটার ছিলো সকাল সাড়ে দশটায়, কিন্তু সেই গেট টুগেদারে অংশগ্রহণ করার সময় আসার আগেই কোর্টে এসে ওদের দেওয়া কাগজে স্বাক্ষর করে চলে গেলেন।
বিএনপির সূত্রের দাবি, আবেদনের কপি দেখেন। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি বরাবর এরকম একটা সাদামাটা ছুটির আবেদন কি করতে পারেন? আর ছুটির আবেদনে দেখেন কতগুলো বানান ভুল। এটা ওখানে বসে বসে আর্মি জেনারেলরা তাড়াতাড়ি এটা তৈরি করায় এটা সাদামাটা এবং শুধু বানান ভুল আর ভুল রয়ে যায়। প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনে কপি দিলাম। তাঁকে যে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া হয়, সে ছবি এখনো হাতে আসেনি। আসলে সেটাও দেবো।
বিএনপির ‘অসুখে’ অবিশ্বাস, অবিশ্বাসের অসুখ:
২১ এপ্রিল ১৯৭৭। বঙ্গভবনে সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকলেন সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান। তাঁর সঙ্গে তাঁর সশস্ত্র অনুগত বাহিনী। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তখন বঙ্গভবনে তাঁর শয়ন কক্ষে, বিশ্রামে। সেনাপ্রধান জিয়া অপেক্ষা করতে পারলেন না। চলে গেলেন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির শয়ন কক্ষে। রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র সেনা সদস্য দেখে ভড়কে গেলেন। কালো সানগ্লাসে ঢাকা জিয়ার চোখ। কর্কশ স্বরে প্রেসিডেন্টকে বললেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট ইউ আর সিক।’ প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রথমে বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘নো আই এম ফাইন’। এবার জিয়া কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন, ‘অফ কোর্স ইউ আর সিক। ইউ উইল রিজাইন নাও।’
বিচারপতি সায়েম ততক্ষণে বুঝলেন। একজন সেনা অফিসার একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ সাইন।’ বিচারপতি সায়েম সেটা পড়লেন, তাতে লেখা শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।
বহুবছর পর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, তাঁর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থে এই ‘অসুস্থতার’ কথা প্রকাশ করেন। শুধু প্রেসিডেন্ট সায়েম নন, জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে ৮ জন সচিব, ৬ জন বিচারপতি, ১২ জন বিভিন্ন কর্মকর্তাকে অসুস্থ বানিয়ে পদত্যাগ করান।
জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেনা প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ‘অসুস্থ’ বানিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করেন। অনেক পরে বিচারপতি সাত্তার সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন যে তাঁকে জোর করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল।
বিএনপি যখন প্রধান বিচারপতির অসুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন করছে, সন্দেহ করছে, তখন আমার মনে প্রশ্ন এলো মানুষের অসুখ, মৃত্যু এসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন? একজন মানুষ তো যেকোনো সময়েই অসুস্থ হতে পারেন। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক, ঠিকঠাক কাজ করছিলেন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এখনতো হাসপাতালের বিছানায় কাটছে তাঁর দিন। স্বাভাবিক একজন মানুষও হঠাৎ অসুখে পড়তেই পারেন। বলে কয়ে ক’জন অসুস্থ হন? কিন্তু এই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ফ্লাশব্যাকে পুরোনো দিনের ঘটনাগুলো ভেসে উঠল।
তখনই আমি আবিষ্কার করলাম, কেন বিএনপির ‘অসুখ’ বিষয়টায় ঘোর অবিশ্বাস। কারণ তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা নেতা তো এই কাজটি করেছেন সব সময়। ‘অসুস্থ’ বলে সুস্থ মানুষকে ক্ষমতা থেকে অস্ত্রের মুখে নামিয়েছেন। একারণেই অসুখে বিএনপির এত অবিশ্বাস।
আহা কি সুন্দর অসুখ:
এই অবিশ্বাসের আরও কারণ আছে। বেগম জিয়া অসুখের চিকিৎসার জন্য মধ্য জুলাইয়ে গেলেন লন্ডনে। তিনমাস হতে চলল, এখনো তাঁর অসুখের খবর আমরা পেলাম না। তিনি কেমন আছেন, দেশবাসী জানে না। যে দলের প্রধান নেতা ‘অসুখ’ এর ভান করে বিদেশে অবকাশ যাপন করেন, সে দলের অন্যান্য নেতারা কীভাবে ‘অসুখ’ বিশ্বাস করবেন। কীভাবে বুঝবেন, এই অসুস্থতা বেগম জিয়ার অসুস্থতা নয়? শুধু প্রধান নেতা নয়, দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক জিয়াও লন্ডনে দীর্ঘ নয় বছর।
প্রায়ই বিএনপির নেতারা তারস্বরে চিৎকার করে বলেন, ’তার চিকিৎসা চলছে, এজন্যই তিনি লন্ডনে।’ কী দূরারোগ্য ব্যাধি তারেক জিয়ার যার চিকিৎসা নয় বছরেও শেষ হয় না। আহা কি সুন্দর অসুখ। যে অসুখে জিমে যাওয়া যায়, ক্যাসিনো খেলা যায়, শপিং করা যায়, শুধু দেশে আসা যায় না! বড়ই চমৎকার আসুখ বৈকি! একারণেই বিএনপির ‘অসুস্থতা’ শব্দে ভয়ানক সন্দেহ। অসুখে তাঁদের প্রচন্ড অবিশ্বাস। তাঁদের দলের সংস্কৃতিই হলো ‘অসুস্থতা’ কে মিথ্যার প্রতিশব্দ করা। তাই প্রধান বিচারপতির অসুখ তাঁরা বিশ্বাস করবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক।