টিআইএন॥ ৩৩তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হওয়া তাইমুরের গল্পটা একটু ভিন্ন: পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তিলাভ। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি অবধি যার রোল নাম্বার ছিলো এক, ক্লাসের সেই ফাস্টবয় কিনা এসএসসি পরীক্ষায় রসায়নে পরপর দুইবার ফেল করে বসলো! বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র হিসেবে এমনিতেই সবার আলাদা নজরে ছিলো তাইমুর শাহরিয়ার। ক্লাসের শীর্ষস্থানে থাকা শিক্ষার্থীরা এমনিতেই একটু বাড়তি নজরদারির মধ্যে থাকে। তার ওপরে রোল নাম্বার যদি থাকে এক, তাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার পরিমাণটা বেশিই থাকবে, এটাই ধ্রুব সত্য।
২০০১ সালে নির্ধারিত সময়ে যখন এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল জানানো হলো তখন অনাকাঙ্খিত ফলাফল শুনে ঘাবড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না কারোরই। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সকল শুভাকাঙ্খীরা তাইমুরের এমন অপ্রত্যাশিত ফলাফলে হতভম্ব। বিশেষ করে তাইমুর শাহরিয়ারের মনের অবস্থা ছিলো অবর্ণনীয়। তাইমুরের ভাষায়- যাকে সাপে কামড়ায়নি, তাকে কি কোনোভাবেই সাপে কামড়ানোর অনুভূতি কেমন সেটা অনুভব করানো যাবে? আমার তখনকার অনুভূতিটাও বলে বোঝানো যাবে না। এটা সম্ভবও না।
সময় থেমে থাকে না। আর দুর্ঘটনা তো জীবনেরই অংশ। সবার সান্তনা নিয়ে পরবর্তী বছরে পরীক্ষা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে তাইমুর শাহরিয়ার। কিন্তু পরবর্তী বছরটাও যে তাইমুরের জন্য প্রথম বছরের মতই পরিণতি ডেকে আনবে তা কি কেউ ভেবেছিল? যেমনটি ভাবেনি তাইমুর শাহরিয়ার নিজেও। যথারীতি পরীক্ষার ফলাফলে রসায়নে সাবজেক্টে পুনরায় ফেল এসেছে।
প্রথম বছরের ফলাফলটা না হয় যে কোনোভাবেই মেনে নেয়া হলো, কিন্তু মনকে শক্ত রাখার জন্য সান্তনার কোনো বাণী কি তাইমুরকে প্রভাবিত করতে পারবে এবার? জীবনের সর্বোচ্চ হতাশার মুহূর্তে তাইমুরের বাবা মোঃ মোতালেব হাওলাদারের (নান্নু) কয়েকটি কথাকে পুঁজি করে সেবছরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করতে পেরেছিল তাইমুর। তাইমুরের বাবার কথাগুলো ছিলো এরকম- “জ্বলার মতো আগুন থাকলে তা একদিন জ্বলে উঠবেই। দেরিতে হলেও। প্রতিভা থাকলে তা একদিন প্রকাশ পাবেই। তাই ঘাবড়ানোর কিছু নেই”।
সন্তানের দুঃসময়ে সব বাবা-মা প্রায় একই বাক্য বলে সন্তানকে আশ্বস্ত করে থাকে। সেদিক বিবেচনায় তাইমুরের বাবার কথাগুলো খুব একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য বহণ করে না। হয়তো ছেলেকে বোঝানোর ধরণটা ভালো ছিলো বলে তাইমুর শাহরিয়ার বাবার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছিল। অন্য কারো ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়তো অনেকটাই বেগ পেতে হতো। ২০০১ সালে যার পাশ করার কথা সেই তাইমুর অবশেষে পাস করলো জিপিএ ৩.৭৫ নিয়ে দুই বছর পরে ২০০৩ সালে। বরগুনার আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে।
এরপর আমতলী ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৮০ পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। ২০০৯ সালে পর্যায়ক্রমে অনার্স এবং ২০১০ সালে মাস্টার্সপর্ব শেষে প্রস্তুতি নেয় বিসিএস পরীক্ষার জন্য। ততদিনে পূর্বের দুই বছরের ফলাফল খারাপের ঘটনাটি অতীত। পুরোদমে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুুতির চলতে থাকে।
৩১তম বিসিএসে অংশ নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও সে বছর পরবর্তী ধাপ অতিক্রম করা হয়ে ওঠেনি। ৩২তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল অনুপস্থিত। এই সময়টাতে তাইমুর শাহরিয়ার নিজেকে আরও ঋদ্ধ করতে ব্যস্ত সময় পার করে। অবশেষে ৩৩তম বিসিএসে অংশ নেয়া তাইমুরের আত্মবিশ্বাস ছিলো আকাশচুম্বী। পরীক্ষায় পরপর দুইবার ফেল করা ছাত্রটি তখন বিসিএস পরীক্ষায় অন্যদের চেয়েও তুমুল আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে উপস্থাপন করে। পছন্দ তালিকার প্রথমে পুলিশ ক্যাডার এবং দ্বিতীয়টি প্রশাসন ক্যাডারে থাকলেও তাইমুরের ভাগ্যে ছিলো শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হওয়ার গৌরবময় স্থানটি!
ফেল করা ছাত্রটি অবশেষে কিনা শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিলো। সেই সাথে পরোক্ষভাবে এও জানান দিলো যে, অপেক্ষার ফল অবশেষে মিষ্টিই হয়, অপেক্ষাটা করতে হবে অবশ্য দৃঢ়তার সাথে। এটা যারা বুঝতে পারে তারা টিকে থাকবে, বাকীরা এমন আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে, এই যা।
শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম হওয়ার পর তাইমুরের প্রথম কর্মস্থল ছিল বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। আড়াই বছর চাকুরী শেষে চলতি বছরের ১লা মার্চ থেকে বদলি ভিত্তিক পদায়নের ভিত্তিতে ঢাকার সরকারি কবি নজরুল কলেজে বর্তমানে কর্মরত।
সার্বিক বিষয়ে তাইমুর শাহরিয়ারের বক্তব্য হচ্ছে- সবাই বলে ‘ভাঙবো তবু মচকাবো না।এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত দর্শনটা ভিন্ন। ভেঙে গেলে তো শেষ! আমার মত হচ্ছে ‘মচকাবো তবু ভাঙবো না, সাময়িকের জন্য আমি হয়তো মচকে গিয়েছিলাম, কিন্তু ভেঙে পড়িনি।’ প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করে আত্মহত্যাজনিত অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর আমরা পাই। তাইমুর শাহরিয়ারের জীবনের ঘটনা থেকে কি আমরা এর বিপরীত শিক্ষাটা নিতে পারি? প্রয়োজনে সাময়িকের জন্য মচকে গেলেও, ভেঙে পড়া যাবে না কিছুতেই।