আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
লন্ডন থেকে চপল॥ বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন এখনও কিছুটা দূরে আছে। কিন্তু প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সংশয় ছিল বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যোগ দেবে কিনা। নানা মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসায় মনে হয়, আগামী নির্বাচনে বিএনপি যোগ দেবে। দলের পাতি নেতারা যাই বলুন, লন্ডনে বসেই মাতা-পুত্র (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা নির্বাচনে যাবেন। নইলে বিএনপির অস্তিত্ব থাকবে না।
লন্ডনে সম্প্রতি যে গুজবটি রটেছে, তা-ও সত্য হবে বলে ধারণা করি। গুজবটি হল, তারেক রহমান এতকাল বিভিন্ন মামলায় দন্ডিত হওয়ার ফলে জেলে যাওয়ার ভয়ে দেশে ফেরেননি। কিন্তু নির্বাচনের আগে তিনি দেশে ফিরবেন। বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরও অনেকের আশঙ্কা, নির্বাচনের আগে আগে বেগম জিয়া কোনো না কোনো মামলায় দন্ডিত হয়ে জেলে যাবেন। তাতে দলের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং নেতৃত্বহারা বিএনপি নির্বাচনে আদৌ সুবিধা করতে পারবে না।
যদি তাই হয়, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দলের মনোবল চাঙ্গা রাখবে। আমি বিএনপির এক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারেক রহমান তো বিভিন্ন গুরুতর মামলার আসামি, কোনো কোনোটায় দন্ডিত, এই অবস্থায় দেশে ফিরলে যদি তাকে গ্রেফতার করা হয় তাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? নেতা বলেছেন- তাদের আশা, দলের অবস্থা আরও ভালো হবে। নির্বাচনের আগে তারেক জেলে গেলে হিরো হবেন। দেশের মানুষ ধরে নেবে মাতা-পুত্রকে জেলে রেখে সরকার নির্বাচনে ওয়াকওভার চায়। বিএনপিকে তা নির্বাচনে বিশাল জয়ে সাহায্য করবে।
বিএনপির এই নেতাদের আশা- যদি তাই হয়, তাহলে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানকে বেশিদিন জেলে থাকতে হবে না। নির্বাচনী বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে তারা বীরের বেশে জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন। তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা-মোকদ্দমা বাতিল হয়ে যাবে। তারা সরকার গঠন করবেন। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে আর প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন না। রাষ্ট্রপতি হবেন আর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করবেন তারেক রহমান। আওয়ামী লীগ তাদের এতদিনের কর্মফল ভোগ করবে।
এমন একটি সম্ভাবনার কথা ভেবে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশ উৎসাহিত এবং প্রকাশ্যেই তাদের মনের আশা ব্যক্ত করছেন, এটা আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে তারেক রহমানের মতো এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তার পেছনে থাকবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লাদের প্র্রেতাত্মারা, এই আশঙ্কা আমার কাছে এক দুঃস্বপ্ন। আওয়ামী লীগ এবং দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দলগুলো কি এই আশঙ্কা সম্পর্কে সচেতন?
আমার মনে হয় না, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একটা বড় অংশ এ সম্পর্কে সচেতন। তারা একটি সহজ নির্বাচনের সহজ বিজয়ের সুখস্বপ্নে বিভোর। তারা ভাবেন, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বিশাল জনপ্রিয়তা মূলধন করে দল সহজেই নির্বাচন জিতে নেবে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের দু’জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপ হল। তাদের দু’জনেই বললেন, বিএনপি নির্বাচনে কিছুই করতে পারবে না। দেশের রাজনীতিতে বিএনপি নেই, লাখ লাখ দুর্গত রোহিঙ্গাকে দেশে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা যে বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তাতে নির্বাচনে আর কোনো দলের মাথা তোলার কোনো সুযোগই নেই।
আওয়ামী লীগের এক নেতা আমাকে চুপি চুপি বলেছেন, আগে সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির একটা বড় অংশই আওয়ামী লীগের বিরোধী ছিল। নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকাও আওয়ামী লীগের নির্বাচন জয়ের অন্তরায় ছিল। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনের বড় অংশের সমর্থন আওয়ামী লীগের দিকে। এদের সমর্থনে বিএনপির নির্বাচনে সুবিধা করার কোনো আশা নেই।
আমার আশঙ্কা, এই অন্ধ আত্মসন্তোষই আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নেত্রী বিশালভাবে জনপ্রিয়, কিন্তু দল নয়। এটা কোনো দলের নির্বাচনী জয়ের গ্যারান্টি নয়। অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির একটা বড় অংশই চরম সুবিধাবাদী। হাওয়া বুঝে পাল ওড়াতে তারা খুবই দক্ষ।
যদি নির্বাচনের আগে তারা বোঝেন, বাতাস উল্টোদিকে বইছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেদিকেই পাল ওড়াতে তারা দেরি করবেন না। এর একমাত্র প্রতিকার- সংগঠিত দল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ কতটা সংগঠিত ও শক্তিশালী? এক ওবায়দুল কাদের বেশি কথা বলে, বেশি কাজ করে একা আর কী করবেন? নেত্রীর জনপ্রিয়তার তাবিজ এখন দলটির একমাত্র মূলধন।
হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই যেমন বোঝা যায়, ভাত রান্না হয়েছে কিনা, তেমনি নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় দু’একজন কর্মকর্তার আচরণ দেখে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, তাদের মতিগতি কোন্ দিকে। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারাই মনোনীত প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী-সংক্রান্ত আপিলের রায় দানকালে তার একটি ব্যক্তিগত পর্যালোচনা যোগ করে সরকারকে যে বিপাকে ফেলেছিলেন, তার ধাক্কা সরকার এখনও সামলে উঠতে পারেনি।
এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারাই নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা যে কান্ড ঘটালেন তা আরও মারাত্মক। তিনি এক সামরিক শাসককে সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললেন, ওই শাসক দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন এবং বিএনপি দেশ শাসনে নতুন ধারা প্রবর্তন করেছে। এক কথায় তিনি গণতন্ত্র উচ্ছেদকারী হিসেবে জাতির পিতার দিকে ইঙ্গিত করলেন এবং বিএনপিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশংসা করলেন। যদিও এই বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেই তিনি তাদের দলতান্ত্রিক শাসনের শিকার হয়েছিলেন।
এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ‘বিদূষক-চরিত্রের’ একটা বড় প্রমাণ তিনি বিএনপিকে নতুন শাসনধারা প্রবর্তনের জন্য তাদের সামনাসামনি প্রশংসা করেছেন। আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছেন, দেশের সব উন্নয়ন আওয়ামী লীগের আমলেই হয়েছে। হাসব, না কাঁদব? এই ধরনের এক ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে কী জন্য এবং কী কারণে তারা মনোনয়ন দিলেন?
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাজ দেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করা এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধী দলগুলোকে সে সম্পর্কে আশ্বস্ত ও আস্থাশীল করা। কোনো দলের তোয়াজ করা এবং দলটি ও তার নেতাদের সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথা বলা তার দায়িত্ব নয়। বরং সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালনের পথে এটা বড় বাধা।
এই সত্যটি না জেনে বর্তমান সিইসি তার দায়িত্ব কিভাবে পালন করবেন তা আমি জানি না। তার বাচালতাই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ বর্তমান প্রশাসনের মধ্যে তাদের জন্য যে সমর্থন ও সহানুভূতি আশা করে, তা কত ভ্গংুর। বাংলাদেশে এদের অধিকাংশই হাওয়া বুঝে পাল ওড়ান।
তবে এই পরিস্থিতির একটা পজিটিভ দিক আছে। জাতির পিতার প্রতি কথিত কটাক্ষের জন্য প্রধান বিচারপতির পর্যালোচনা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারি ও বেসরকারিভাবে (দলীয়) যে বেসামাল মনোভাব ও আচরণের পরিচয় দিয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জাতির পিতার প্রতি ততধিক কটাক্ষ করা মন্তব্যের জন্য (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হোক) তেমন উগ্র ও বেসামাল মনোভাব ও আচরণ তারা দেখাচ্ছেন না। হয়তো দেখাবেনও না। তার অর্থ, আওয়ামী লীগ সরকার বুঝতে পেরেছে, প্রধান বিচারপতি অবশ্যই ভুল বা অন্যায় করেছেন। তার প্রতিকারের শোভন ও সাংবিধানিক পন্থা ছিল। তার বদলে তারা যা করেছেন তা বৈধ, স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের মর্যাদার অনুকূল নয়। এর খেসারত তাদের দিতে হতে পারে।
সম্ভবত এই বোধোদয় থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আরও বালখিল্য মন্তব্য নিয়ে তারা সোচ্চার তো ননই, বরং বিস্ময়করভাবে নীরব। হয়তো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি ঝামেলায় জড়িত হতে তারা সাহসী হচ্ছেন না।
একশ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী বুঝুন আর না-ই বুঝুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, সামনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগকে প্রমাণ করতে হবে তারা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ দল ও সরকার নয়। গণতান্ত্রিক ধৈর্য ও সহনশীলতা দ্বারা তারা দেশ চালাতে চান। বিএনপির মতো সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসার নীতি দ্বারা নয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই পরিবর্তিত নীতির প্রমাণ, বেগম খালেদা জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সরকার কোনো বাধা দেয়নি। তাকে বিমানবন্দরেই গ্রেফতার করা হয়নি। তার সংবর্ধনার মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়নি, কোনো গন্ডগোল সৃষ্টি করেনি।
আমি নিশ্চিত, বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণাতেও কোনো বাধার সৃষ্টি করা হবে না; একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরির দিকে শেখ হাসিনা কঠোর দৃষ্টি রাখবেন। মনে হয়, দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের সম্বিত ফিরেছে। যদিও তা একটু বিলম্বে ঘটেছে। আরও আগে ঘটলে ভালো হতো। লন্ডন ২২ অক্টোবর, রবিবার ২০১৭