তাজুল ইসলাম নয়ন॥ ঐতিহাসি ৭ই মার্চের ভাষণের পূনরাবৃত্তিই যেন ঘটলো এই নাগরিক সমাবেশে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবি: সৌজন্যে ফোকাস বাংলা)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য আমরা গর্বিত জাতি। আমাদের উন্নত শির যেন আর কোনোদিন পরাভূত না হয় সেজন্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এগিয়ে যাবে, এটাই হোক আজকের প্রতিজ্ঞা।’ শনিবার (১৮ নভেম্বর) বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি এসব কথা বলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার কথায়, ‘ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাই সম্মানিত হয়েছি। তবে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা তোষামোদকারী ও চাটুকাররা যেন আর কখনও ইতিহাস বিকৃত করার সুযোগ না পায় সেজন্য বাংলার মানুষকে জাগ্রত থাকতে হবে।’
এদিনের ঢাকার আকাশ দিনভর মেঘাচ্ছন্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের শেষ দিকে সূর্য উঁকি দেয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এতদিন এরকম মেঘে ছেয়েছিল। আমাদের আকাশে সূর্য নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। এই সূর্যই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে আবারও আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো।’
৭ মার্চের ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও একসময় এটি নিষিদ্ধ ছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এই ভাষণ বাজানোর কারণে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিজয়ী জাতি হিসেবে বিজয়ের ইতিহাস বলতে পারবো না, এটা তো হয় না। এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বোঝা গেলো, ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়।’
পৃথিবীর কোনও ভাষণ ৭ মার্চের ভাষণের মতো এতদিন এত ঘণ্টা ধরে বাজেনি বলে দাবি শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, ‘যাদের এ দেশে জন্ম হয়নি, যারা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করে না কিংবা করতে পারেনি, তারা বঙ্গবন্ধুর নাম ও ৭ মার্চের ভাষণ মুছে ফেলতে চেয়েছে। এ কারণে বাজাতে দেয়নি। এ দেশে বসবাস করলেও তারা মূলত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। কিন্তু তারা যতই বন্ধ করতে চেয়েছে স্বাধীনতার উদ্দীপনা ও চেতনাকে রুখতে পারেনি। আমার প্রশ্ন, বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়া দেখে আজ কি তাদের এতটুকু লজ্জা হয় না?’
অনেক রাষ্ট্রনায়কের ভাষণ ইতিহাসে ঠাঁই পেলেও সেগুলো আগেই লেখা ছিল বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ এমন একটি ভাষণ যার লিখিত কিংবা কোনও নোট ছিল না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেওয়ার আগে পায়চারির সময় আমার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন; তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সেকথাই বলবে। কারণ তুমি জানো তোমার কি কথা বলতে হবে বাঙালি জাতির জন্য।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সব দিকনির্দেশনা ছিল বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানি শাসকরা কখনও ক্ষমতা দেবে না। যুদ্ধ করেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। ৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়েছিল জনগণের ম্যান্ডেট নিতে। তিনি জানতেন নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতা ছাড়বে না পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা। তাই ৭ মার্চের ভাষণে সব দিকনির্দেশনা দিয়ে যান জাতির পিতা। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ সংগ্রহসহ সব পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা তার এই ভাষণে ছিল।’
এ সমাবেশের আয়োজন করে দেশের নাগরিক সমাজ। এখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতিত্ব করেন এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ) বিট্রিস কালদুল।
আলোচনা ছাড়াও সমাবেশে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে আবৃত্তি করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও কবি নির্মলেন্দু গুণ। শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের কণ্ঠে সমবেত গানের পর লোকগান পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রামেন্দু মজুমদার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী।
সমাবেশের কার্যক্রম সমন্বয় করেন পাঁচ সদস্যের নাগরিক কমিটি। তারা হলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, ডা. সারওয়ার আলী, হারুন-অর-রশিদ ও অসীম কুমার উকিল।
৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৪৫ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ১৮ মিনিটের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকো।’ অনেকের মতে, এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।