ভয়ঙ্কর আম্মাজান…রেললাইনেই অর্ধশত মানুষের লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল॥ লাশ পড়ছে। আজ একটি, তো কাল দুটি। কোনোটি দুই ভাগ। আবার কোনোটি তিন বা চার ভাগ করা। রেললাইনের ওপর পড়ে থাকা এসব লাশের অপমৃত্যু মামলা হচ্ছে। তদন্তের সেখানেই শেষ। কিন্তু, প্রশ্ন উঠেছে লাশগুলোর একটি কমন বিষয় রয়েছে। সেটি হচ্ছে প্রত্যেকের গলা কাটা। বিষয়টি গোয়েন্দাদের নজরে আসার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সত্যি তো! গলা কাটা কেন থাকবে? রেলে কাটা মানুষের খন্ড দেহ মিলে। গলা কাটাও থাকতে পারে।

killer ammajan
কিন্তু প্রত্যেক লাশের গলা কেন কাটা থাকবে? গোয়েন্দারা মাঠে নামে। শুরু হয় তদন্ত। ২০১১ সালে পুলিশ প্রশাসনের পিলে কেঁপে উঠে এমন অসংখ্য গলা কাটা লাশ উদ্ধারের পর। যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছিল আম্মাজান। এটি একটি ছোরার নাম। অত্যন্ত ধারালো ছোরা। সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর ওই ছোরা দিয়ে গলা কেটে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয় যাত্রীদের। প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্না ‘আম্মাজান’ ছবিতে একটি বিশেষ ছোরা ব্যবহার করেন। ওই ছোরা দেখতে যেমন ছিল সে ধরনের ছোরা ব্যবহার করে এ গ্রুপের সদস্যরা। এ কারণেই তাদের গ্রুপের নাম আম্মাজান। ছোরার নাম অনুসারে এ দুর্বৃত্ত চক্রের নাম হয়েছে আম্মাজান গ্রুপ। এ গ্রুপের প্রধান জীবন ওরফে অসহায় জীবন গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে এসে তাদের নৃশংসতার নানা তথ্য দেয়। তবে গলা কাটার সেই তৎপরতাও কমে। পুলিশ বলছে, এ চক্রের হাতে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে শতাধিক যাত্রী। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ঘাতক চক্রের হাতে নিহত হওয়য় এসব যাত্রীর লাশও পাচ্ছেন না স্বজনরা।
২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জামালপুর রেল স্টেশনের অদূরে গলা কাটা ৬ যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বলে অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে নিহতদের মধ্যে দুজনকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে শনাক্ত করা হয়। অপমৃত্যুটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করে তদন্ত শুরু করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। তদন্ত চলাকালে ৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল স্টেশনের কাছে পাওয়া যায় আরও দুজনের গলা কাটা লাশ। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া দ্রুতযান ট্রেনের ৬ যাত্রীর কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে গলায় ছোরা চালিয়ে তাদের ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাক্রমে বেঁচে যান ৪ যাত্রী। তারা ঘাতকদের সম্পর্কে পুলিশের কাছে নানা তথ্য দেন। তদন্তের একপর্যায়ে গ্রেফতার করা হয় দুধর্ষ কিশোর সন্ত্রাসী বিল্লাল ওরফে বিলাইকে। তার তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় চক্রের ৪ সদস্যকে। এরা হলো রকি ওরফে বড় রকি, রনি ওরফে বড় রনি, ছোট রনি ও সোহেলকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি ধারালো আম্মাজান ছোরা।
পুলিশের জেরায় জানায়, ঢাকায় আছে মোশারফ। তাদের বস। তার কাছে লুটের মাল রাখা হয়। পুলিশের হাতে ধরা পড়ল সেই মোশারফ। গ্রেফতারের পর মোশারফ পুলিশকে জানায়, সে একটি গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সেটি তার মূল পেশা নয়। সে পত্রিকায় বিদেশে অবস্থানরত লোভনীয় পাত্র-পাত্রীর বিয়ের বিজ্ঞাপন দেয়। লোকজন বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে এলে সে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বলে। সেখানে আসার আগেই আম্মাজান গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়।
আম্মাজান চক্রের গ্রেফতার হওয়া সদস্যরা জানিয়েছে, ওই বছর তারা নগদ অর্থসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার মালামাল লুট করেছে চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে। তাদের হাতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে অর্ধশত ব্যক্তি।
তৎকালীন সময়ে জিআরপি পুলিশে ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, তখন উদ্ধারকৃত লাশের বেশির ভাগের গলা কাটা পাওয়া যেত। এ ছাড়া চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ায় অনেক লাশ ট্রেনের নিচে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। ফলে লাশের পরিচয় শনাক্ত করাও যায় না।
চক্রের প্রধান গ্রেফতারকৃত জীবন ওরফে অসহায় জীবনের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তার সহযোগীদের বয়সও ২০ বছরের কম। জীবন গোয়েন্দাদের জানায়, বাস বা অন্যান্য পরিবহনের যাত্রীদের টার্গেট করার চেয়ে ট্রেনের যাত্রীদের টার্গেট করা সহজ। কারণ ট্রেন যখন-তখন থামানো যায় না। এ ছাড়া ট্রেনে পুলিশও তেমন একটা থাকে না। কোনো একজন যাত্রীকে টার্গেট করা হয়। সে যখন সিট ছেড়ে উঠে বাথরুমে যায় বা খোলা দরজার কাছে দাঁড়য় তখনই তাকে আক্রমণ করা হয়। এ ছাড়া ট্রেনের ছাদের যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে সহজেই তাদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া যায়। আবার অনেক সময় একটি পুরো বগির দুই দিকের দরজা লাগিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করা যায়। এরপর যাত্রীদের সব কিছু কেড়ে নেওয়া সহজ হয়। আম্মাজান চক্রের হাতে আক্রান্ত হওয়ার পরও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ফেনীর যাত্রী স্কুলশিক্ষক আমীর হোসেন।
তিনি ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থেকে মহানগর গোধূলি ট্রেনে ওঠেন। মাঝপথে রাত নামে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি ট্রেনে বাথরুমে যান। বাথরুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় ছোরা চেপে ধরে ৪-৫ জন কিশোর। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমীর হোসেনের মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। এতে তার একটি হাত ট্রেনের চাকার নিচে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি পুলিশের কাছে ওই চক্রের সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য দেন। পরে আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাতে তারা জানায়, ঠিক কতজন যাত্রীকে তারা হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব রাখেনি। তবে এ সংখ্যা অর্ধশত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.