শেখ কামাল॥ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন গৃহঋণ দেওয়ার জন্য গ্রাহক খুঁজছে। যারা ফ্ল্যাট কেনা বা বাড়ি তৈরি করতে আগ্রহী, তাদেরই এই ঋণ দিতে চায় এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, এই খাতের গ্রাহকরা ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য খাতের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে গৃহঋণকেই। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে ঋণ-প্রক্রিয়াও সহজ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, এই খাতে ঋণখেলাপি ও সুদের হারও কম। আবার ফ্ল্যাটের দামও আগের চেয়ে বেশ কিছুটা কমেছে। এককথায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য খাতের চেয়ে আবাসন খাতে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছে। জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান বলেন, ‘আবাসন খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনেক নিরাপদ। এই খাতে এখন সুদের হারও অনেক কম। আমরা সিঙ্গেল ডিজিটে গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছি। মানুষ বছরের পর বছর ভাড়া বাসায় না থেকে নিজের বাসায় থাকার সুযোগ পাচ্ছে।’
এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণ ঋণের চেয়ে গৃহঋণে খেলাপি তুলনামূলকভাবে কম। ২০০৬ সালে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তখন গৃহঋণে খেলাপি ছিল ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু তখনও গৃহঋণে খেলাপির হার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘ফ্ল্যাট-ক্রেতাদের ঋণ পরিশোধ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তাদের ৯৯ শতাংশই ঋণ সময়মতো পরিশোধ করেছেন। এ কারণে এ খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন কোনও ঝুঁকি নেই।’
জানা গেছে, গত তিন বছর ধরে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বাড়ির ভাড়া কয়েকগুণ বাড়লেও ফ্ল্যাটের দাম সেই তুলনায় বাড়েনি। একইভাবে জমির দামও বাড়েনি। উপরন্তু এই সময়ে সুদের হার কমেছে। আবাসন খাতে সুদের হার এখন ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে। যদিও একই সময়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বেড়েছে কয়েকগুণ। এমন পরিস্থিতিতে আয়কর সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা নিতে অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনছেন।
বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স (আয়কর) সুবিধা নিতে অনেকেই ব্যাংকের টাকায় ফ্ল্যাট কেনেন। হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও ব্যাংক ঋণ দেখানোর মাধ্যমে অনেকেই কর রেয়াত সুবিধা নেন।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পর থেকে আবাসন খাতে ঋণবিতরণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৪ সালে ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল গৃহঋণ। ২০১৫ সালে সেটা বেড়ে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ হয় এবং ২০১৬ সালে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়। আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে গৃহঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। একই সময়ে আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইসলামী, আইএফআইসি, ব্র্যাক, ইস্টার্নসহ কয়েকটি ব্যাংক ফ্ল্যাট কিনতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ডেলটা ব্র্যাক হাউজিং ফিন্যান্স করপোরেশন (ডিবিএইচ), আইডিএলসি, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফিন্যান্স ফ্ল্যাট কিনতে ঋণ দিচ্ছে। ঋণের সুদের হার ৯-১২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘এখন সিঙ্গেল ডিজেট সুদেই পাওয়া যাচ্ছে ফ্ল্যাট কেনার ঋণ। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে কিছুটা সময় লাগলেও আমাদের প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার সাত মাত্র দিনের মধ্যেই এক কোটি টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার এখন সুর্বণ সময় যাচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, দেশের ব্যাংকগুলো বর্তমানে ৭০ অনুপাত ৩০ ঋণ-মার্জিনে গৃহঋণ দিচ্ছে। অর্থাৎ বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে খরচ বা দামের ৩০ শতাংশ গ্রাহককে জোগাড় করতে হয়। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যাবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কিনতে মোট খরচের ৭৫ শতাংশই ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন। অর্থাৎ কোনও প্রবাসী দেশে ১ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি কিনতে চাইলে তিনি ২৫ লাখ টাকা রেমিট্যান্স পাঠাবেন। বাকি ৭৫ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘গৃহঋণের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে একটি নীতিমালা তৈরির বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা তৈরি হলে গ্রাহকরা সহজে ঋণ নিতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে মানুষ যেন গৃহনির্মাণে ঋণ পায়, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।’
এদিকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) বর্তমানে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে এক কোটি টাকা পর্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ, গ্রুপ, ফ্ল্যাট, বর্ধিত, ২০ বছর মেয়াদি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত, পাঁচ বছর মেয়াদি বিশেষ ও সেমিপাকা এমন সাত ধরনের ঋণ দিচ্ছে। এতে সুদ আরও একদফা কমাতে চায় বিএইচবিএফসি। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে গৃহ ঋণ ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ, আর ফ্ল্যাট কেনায় সুদের হার ১০ শতাংশ করা হয়। এখন সুদের হার ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।