তাজুল ইসলাম হানিফ॥ পেট্রেসিয়া আগাথা বিউটেনিস’ একজন নামকরা আমেরিকান আমলা। তিনি পড়াশোনা করেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন রোয়াল্ড হোফম্যান, যিনি ১৯৮১ সালে রসায়ন শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান। লক্ষ করার বিষয় হলো, ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়ার নিজেদের ওয়েবসাইটে তাদের বিখ্যাত গ্র্যাজুয়েটদের তালিকায় হোফম্যানের নাম রাখলেও বিউটেনিসের নাম রাখেনি। সোজা কথায় তুখোড় সরকারি কর্মকর্তাকে লিস্টেড না করে তারা একজন গবেষককে তালিকাভুক্ত করে। আর এটা কিন্তু স্বাভাবিক। পৃথিবীতে সরকারি আমলা প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় বা যে কোনো পর্যায়ের দাপ্তরিক কাজের জন্য। কিন্তু সভ্যতা এগিয়ে নিতে এর চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিজ্ঞানীর, গবেষকের, লেখকের কিংবা সৃষ্টিশীল কাউকে। একটি দেশের মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যদি ভুল কোনো সামাজিক বার্তায়, পারিবারিক চাপে গবেষণা বা উচ্চতর পড়াশোনা বাদ দিয়ে নীলক্ষেতের ওরাকল বা ফার্মগেটের কোচিং নির্ভর হয়, তাহলে এর চড়া দাম ভবিষ্যতে সেই দেশকে কিন্তু দিতে হবে।
আমি আমার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একটি মেধাবী ছেলের কথা একটু বলি। ছেলেটি থার্ড ইয়ারে গিয়ে অন্য কিছু পড়ার চেয়ে ওরাকল নামের একটি বইয়ে সময় বেশি দিচ্ছিল। কারণ তার বাবা-মা চায় ছেলে বিসিএস ক্যাডার হোক। এই ছেলেটি ভালো ক্যামিস্ট হতো, গবেষণা করে অনেক কিছুই করতে পারতো দেশের জন্য, কিন্তু এখন সে অদ্ভুত এক অপ্রয়োজনীয় সিলেবাস মুখস্থ করে চলেছে। নাহ, ওর দোষ নেই। কিন্তু আমরা যখন সবচেয়ে মেধাবীদের অনেকটা জোর করে একাজ করাচ্ছি, তখন হয়তো একবারও ভাবছি না, ক্ষতিটা কীভাবে কার হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা ভবিষ্যতে ভালো গবেষক বা বিজ্ঞানী আর পাবো ?
এদেশে জন্ম নিলে আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিসিএস ক্যাডার হতেন পরিবারের চাপে। অথচ বাংলাদেশের নায়ক যাদের ভাবা হয়, তাদের তালিকায় চোখ বুলিয়ে দেখেন না আমাদের বাবা-মায়েরা। সেই নায়কদের কি কেউ বিসিএস ক্যাডার ? ব্যাপারটা খুবই আতংকিত হওয়ার মতো হলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বিসিএস সাফল্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ভেবে কথা বলে বসেন। সত্যিকার অর্থে তখন বিশ্ববিদ্যালয় আর কোচিং সেন্টারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে কী ? ? ?
রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান ভান্ডারের রক্ষক। কেবল রক্ষক নয় বরং সেই জ্ঞানকে সাধনার মাধ্যমে, বোধশক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। প্রকৃত শিক্ষক তারা যারা জ্ঞানী, সৎ, দায়িত্বশীল এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। এরা গবেষণা করেন মানুষের জন্য, বই লিখেন মানুষের জন্য, এরা জাগতিক লোভের কাছে বিক্রি হয়ে যান না। শত ব্যস্ততা থাকলেও এরা ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনো ক্লাস ফাঁকি দেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু পড়াশুনাই তাদের লক্ষ নয়, তাদেরকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং জ্ঞান সৃষ্টি ও প্রসারের কেন্দ্রস্থল। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা করতে। দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে তাদের মেধা, মনন বিকাশের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনাকে স্মরণ রেখে বলতে হয়, প্রতিষ্ঠা-লগ্ন থেকেই এদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ ছিল জ্ঞান সৃষ্টি করা, জ্ঞান-জগতের অভিনব উদ্ভাবনের নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের নিয়ত নিয়োজিত রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একাধারে জ্ঞানদান করেন, নিজে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আত্মনিমগ্ন থাকেন, শিক্ষার্থীর সুপ্তজ্ঞান, অভীপ্সা জাগিয়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন, সর্বোপরি মানব কল্যাণে জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানার্জনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সত্য অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় সমাপ্তির পর একজন শিক্ষার্থী কেবল একটি সনদ উপার্জনের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মার্কেট ভ্যালুর চেয়ে সোস্যাল ভ্যালু তৈরি করা জরুরি যা রবীন্দ্র ভাবনা থেকে আমরা শিখেছি।
একটি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সেই দেশের সৃজনশীলতার সূতিকাগার। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজকে এগিয়ে নেয় এ ভাবনা আমাদের অস্থি-মজ্জায় লালন করা দরকার। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে সকল দলের ও মতাদর্শের সমন্বয় সাধন হবে। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। স্বাধীনভাবে সকলের মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা হবে যুক্তিবাদী। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরাই নিরেট সত্য প্রতিষ্ঠা করবে তবেই শিক্ষাঙ্গণ হয়ে উঠবে সঠিক জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আধুনিক জ্ঞান অনুসন্ধান, জ্ঞানের চর্চা ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের তীর্থস্থান। তাই মেধবীরা নিজেদের অনেক বেশি উন্নত করতে, চিন্তাকে প্রসারিত করে নানা আবিষ্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিসিএস ক্যাডার শুধু নয়, এর চেয়ে বেগবান কোনো স্বপ্ন হোক আজকের তরুণদের, এর চেয়ে তাজা কোন জীবন সে অর্জন করতে শিখুক; যা তাকে বিশ্ব সভ্যতায় বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ। লেখক – “হাসান হামিদ”।