কী ঘটেছিলো চট্টগ্রামের রীমা কমিউনিটি সেন্টারে মহিউদিন চৌধুরীর কুলখানিতে

রবিউল, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি॥ চট্টগ্রামে সদ্য প্রয়াত সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে অংশ নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রায় অধিকাংশই হিন্দু। নিহতের বাড়িসহ মোট ১৩টি কমিউনিটি সেন্টারে কুলখানির আয়োজন করা হলেও যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছে সেই রীমা কমিউনিটি সেন্টারে শুধু অমুসলিমদের জন্যে মেজবানের আয়োজন করা হয়েছিলো।
বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে এই সেন্টার থেকে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। দুর্ঘটনার আগে তিন দফা খাবার পরিবেশন করা হয়ে যায় এবং বেলা দেড়টার দিকে সেন্টারের মূল ফটকের কাছে কয়েকশো লোক জড়ো হযেছিলো সেন্টারটিতে প্রবেশ করার জন্যে।
চট্টগ্রাম থেকে সাংবাদিক মিঠুন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, এক পর্যায়ে সমবেতরা ধাক্কা দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, “সেন্টারের প্রবেশ পথটি ছিলো ঢালু। এই ঢালু পথ দিয়ে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।”
chittagong death in m kiulkhani 2
“প্রবেশ পথটি ঢালু হওয়ার কারণে ভিড়ের সামনের দিকে থাকা লোকজন নিচে পড়ে যায়। তখন পেছনের দিকে যারা ছিলো তারা তাদের উপর দিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যান,” বলেন সাংবাদিক মিঠুন চৌধুরী। তখনই পদদলিত হয়ে লোকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বলে তিনি জানান। এতে মোট ১০ জন নিহত হয়েছে যাদের ৯জনই হিন্দু। রীমা কমিউনিটি সেন্টারের দুই ফটক ও সড়কে প্রচন্ড ভিড়। পশ্চিম গেটে সবার সামনেই ছিলেন কৃষ্ণপদ দাশ। গেট খুলতেই হাত থেকে মোবাইলটি ছিটকে পড়ে। কিছুটা ঢালু জায়গা থেকে সেটি নিতে গিয়ে পেছন থেকেই প্রচন্ড ধাক্কায় লুটিয়ে পড়েন কৃষ্ণপদ। তার পেছনে থাকা ২০-২৫ জন পদদলিত হন। পেছন থেকে তখনো মানুষ ঢুকছিলো। মূহুর্তেই সেখানে প্রাণ যায় ১০ জনের।
বন্দর নগরীর রীমা কমিউনিটি সেন্টারে সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানীতে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কৃষ্ণপদ একজন জেলে। নগরীর কাট্টলীর জেলেপাড়ায় তার বাসা। ৫ বছরের এক ছেলে ও দেড় বছরের এক মেয়ে ছিল তার। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বামী কৃষ্ণপদ’র জন্য আহাজারি করছিলেন সারথি দাশ। কৃষ্ণের কাকাতো ভাই মিন্টু দাশ বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্য কৃষ্ণ পাগল ছিল। তাই সে কুলখানিতে গেছে। তার মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। সেটা তুলতে গিয়ে কৃষ্ণ পড়ে যায়। আমরা তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পেছন থেকে যেভাবে ধাক্কা দেয়া হচ্ছিলো তাকে তোলা সম্ভব হয়নি। আরো কয়েকজন পড়ে যায়। মূহুর্তের মধ্যেই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়।
ও বাপ্পী, ওঠো : ‘বাপ্পী তোমার কী হয়েছে ? ও বাপ্পী, ওঠো’- কেবল এ দুটি লাইন বলতে বলতে মূর্ছা যাচ্ছিলো প্রদীপ তালুকদারের দুই কন্যা রিফা তালুকদার ও হীরা তালুকদার। রিফা এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছোটজন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। প্রদীপ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সোমবার সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলেই বাসা থেকেই বের হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুপুরে তার মৃত্যু সংবাদ পায় পরিবার। বিকেলে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলো প্রদীপের দুই কন্যা ও স্ত্রী।
পদদলিতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনুপ দাশ। তিনি নিজেও পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘ফটকের বাইরে অনেক মানুষের ভিড়। ঢোকার সময় ঢালু জায়গায় থাকা বেশ কয়েকজন পড়ে যায়। তাদের গায়ের ওপর দিয়েই পেছনের লোকজন হুড়মুড় করে ঢোকার চেষ্টা করায় এ ঘটনা ঘটেছে।’
কৃষ্ণপদ ও প্রদীপের মতো রীমা কমিউনিটি সেন্টারে প্রাণ গেছে আরো আটজনের। এ ছাড়া আহত হন আরো অন্তত ১৫ জন। নিহতদের মধ্যে অন্যরা হলেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দীপংকর দাশ, পাহাড়তলীর ঝন্টু দাশ পিন্টু, বাঁশখালীর সুধীর দাশ, ধনা শীল, আনোয়ারার লিটন দেব, সীতাকুন্ডের অলক ভৌমিক, সূচরিত দাশ খোকন ও সুমন দাশ।
রীমা কমিউনিটি সেন্টারের সঙ্গে নগরীর আরো ১৩টি কমিউনিটি সেন্টারে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিনের কুলখানির আয়োজন করা হয়। সেখানে তার পরিবারের পক্ষ থেকে লক্ষাধিক মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে রীমার আয়োজন ছিল অমুসলিমদের জন্য। এ কারণে নিহতদের সবাই হিন্দু ধর্মের। সেখানে খাবারের আয়োজন কিছুটা দেরিতে শুরু করায় মানুষের ঝটলা বেশি ছিল বলে জানিয়েছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। এ ছাড়া এন মোহাম্মদ কমিউনিটি সেন্টারেও হুড়োহুড়ির ঘটনায় ৫ জন আহত হয়।
পদদলনের ঘটনার পর পরই হতাহতদের দেখতে চমেক হাসপাতালে যান মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি সেখানে সবার পরিবারকে সান্তনা দেন এবং নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন। পরে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মাসুদুর রহমান সিকদার জানান, মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবার থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ ও আহতদের চিকিৎসা ব্যয় এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এ ছাড়া রাউজানের এমপি ফজলে করিম চৌধুরীও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন।
chittagong death in m kiulkhani 3
এদিকে পদদলনের ঘটনার পর নগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার রীমা কমিউনিটি সেন্টার পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে কার আগে কে ঢুকবে এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পদদলনের ঘটনা ঘটেছে। কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশপথ কিছুটা ঢালু হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।
কুলখানির সমন্বয়ক নগর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন প্রশান্তিকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, শৈবাল দাশ সুমনসহ স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এই কমিউনিটি সেন্টারের আয়োজন সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তারা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তবে মানুষের ঠেলাঠেলিতে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম প্রশান্তিকে জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে আরো অন্তত ৩-৪ জনের অবস্থা আশংকাজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.