রাজুল ইসলাম॥ মুনাফা কম হলেও নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এখন সঞ্চয়পত্র। জনগণকে সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করা ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণ করার নামই সঞ্চয়পত্র। ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় দিন দিন সঞ্চয়পত্রের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ব্যাংকের বাইরে অন্য খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকি রয়েছে, আছে পদে পদে ঝক্কি, লোকসান কিংবা প্রতারণার ঝুঁকি। তাই এ ধরনের মানুষের জন্য সঞ্চয়পত্র হতে পারে আদর্শ বিকল্প।
সঞ্চয়পত্রের ধরন: বর্তমানে দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এগুলো পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র; তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এর বাইরে আছে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে বিনিয়োগ সুবিধা।
পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র: পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র; মুনাফার হার মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে মেয়াদের আগে নগদায়ন করলে প্রথম বছর শেষে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, তৃতীয় বছর শেষে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং চতুর্থ বছর শেষে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়। এটি দেশের সবচেয়ে পুরোনো সঞ্চয়পত্র, চালু হয় ১৯৭৭ সালে। দেশের যে কোনো নাগরিক এটা কিনতে পারেন।
বাজারে ১০, ৫০, ১০০ ও ৫০০ টাকা; ১০০০, ৫০০০, ১০০০০, ২৫০০০ ও ৫০০০০ টাকা এবং ১ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে একক নামে ৩০ লাখ ও যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। তবে প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নির্ধারিত নেই।
৩ মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র: তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফা-ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। তবে মেয়াদের আগে নগদায়ন করলে প্রথম বছরে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় বছর শেষে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ২১ হাজার টাকা এবং তৃতীয় বছর শেষে ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৩৩ হাজার ১২০ টাকা পাওয়া যায়। চালু হয় ১৯৯৮ সালে। পাওয়া যায় ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানে। এটিও সবাই কিনতে পারেন। এই সঞ্চয়পত্র একক নামে ৩০ লাখ টাকা ও যৌথ নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেনা যায়।
এক লাখ টাকায় তিন মাস অন্তর মুনাফা-ভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে প্রতি তিন মাস অন্তর মুনাফার কিস্তি সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ হারে দুই হাজার ৭৬০ টাকা পাওয়া যায়। তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লেভি চার্জ কেটে নেয়া হয়।
এ সঞ্চয়পত্র বাংলাদেশের যে কেউ কিনতে পারেন। নমিনী নিয়োগ করা যায়; ক্রেতা মারা গেলে নমিনী যে কোনো সময় সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করতে পারবে। নমিনীর ইচ্ছানুযায়ী মেয়াদের আগে বা পরে সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করতে পারে। সঞ্চয়পত্র হারিয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা নষ্ট হলে ডুপ্লিকেট সঞ্চয়পত্র ইস্যু করা যায়; সঞ্চয়পত্র এক অফিস থেকে অন্য অফিসে স্থানান্তর করা যায়। সঞ্চয়পত্র কেনার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্ট অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রের ফটোকপি এবং ক্রেতা ও নমিনী (যদি থাকে) প্রত্যেকের দুই কপি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হয়।
(গ) পরিবার সঞ্চয়পত্র : পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র; মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। সঞ্চয়পত্রটি ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানে বিক্রি হয়।
২০০৯ সালে চালু হওয়া এ সঞ্চয়পত্র থেকে মাসিক মুনাফা নেওয়ার সুযোগ আছে। একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। তবে সবাই এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। কেবল ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী যে কোনো বয়সী নারী-পুরুষ এবং ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী নারী ও পুরুষরা এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র : পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এই শ্রেণিতে ৫০ হাজার, ১ লাখ, ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পাঁচ ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। ২০০৪ সালে চালু হওয়া এ সঞ্চয়পত্র থেকে তিন মাস পরপরও মুনাফা তোলা যায়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরাই শুধু এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
এছাড়া ডাকঘর সঞ্চয়পত্র নামে আরো একটি সঞ্চয়পত্র স্কিম রয়েছে। যা শুধু ডাকঘর থেকে লেনদেন করা হয়। তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বর্তমানে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। ডাকঘর থেকে এ সঞ্চয়পত্র কেনা ও নগদায়ন করা যায়। যে কেউ এই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
সঞ্চয়পত্র কিনতে যেসব কাগজপত্র লাগে: বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রের জন্য আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হয়। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের জন্য ক্রেতার দুই কপি ছবি, তার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। ক্রেতা কোনো নমিনী বা উত্তরাধিকারী দিতে চাইলে তারও দুই কপি ছবি দিতে হয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট ফরমে তার সই প্রয়োজন। পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ফরম এর সঙ্গে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূরণ করা আনুতোষিক ও ভবিষ্য তহবিলের সনদপত্র জমা দিতে হয় । অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা শিশুর নামেও সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। চাইলে নির্ধারিত ফরম পূরণের মাধ্যমে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা যায়।
ওয়েজ আর্নার বন্ড: এই বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর। বার্ষিক সুদের হার ১২ শতাংশ। প্রতি ছয় মাস পর পর সুদ তুলে নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে বিনিয়োগকারী মেয়াদ পূর্তির আগে সুদ উত্তোলন না করলে তা মূল টাকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে চাইলেই সবাই ওয়েজ আর্নার বন্ড কিনতে পারেন না। সরকারি-বেসরকারিভাবে যেসব বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত তারা অথবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধির নামেই কেবল এই সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।
কোথায় মিলবে এই সঞ্চয়পত্র : জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ তফসিলী ব্যাংক এবং ডাকঘর থেকে ক্রয় ও নগদায়ন করা যায়। তথ্যসূত্র: জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, আরটিভি অনলাইন।