ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করছেন: ড. তুরিন আফরোজ

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল ও চেয়ারপার্সন, আইন বিভাগ, ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। একই সঙ্গে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সফল হলেন। এবার আপনাদের দাবী কি?     torin afroz
তুরিন আফরোজঃ আমাদের এবারের দাবি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার। মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির আমলে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। আওয়ামীলীগ আমলে সাড়ে এগারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে বাঙ্গালী জাতির সূর্য সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি আমাদের কাছে অনেক বড় মাহাত্ম্যময়। সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও অপমান করা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ঠিক তেমনি যদি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও থাকে, তারা যদি সমান সম্মান দাবি করে সেটা হবে দেশ জাতির সঙ্গে প্রতারণা। সকল শহীদের সঙ্গে প্রতারণা। সুতরাং আমাদের এখানে কেন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকবে!
মহান মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পরেও ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কেন ? এটার জন্য কে দায়ী?
তুরিন আফরোজঃ দায়ী হচ্ছে আমাদের প্রক্রিয়া। মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধীকরণের বা অন্তর্ভুক্তিকরণের যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়া এবং মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির  সংজ্ঞায়ন মোট বারো বার করা হয়েছে। সর্বশেষ কয়েকদিন আগেও করা হলো। প্রশ্ন হল, আমরা এতোবার কেন সংজ্ঞায়ন করছি। ১৯৭২ সালে কিন্তু একটি অর্ডারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ন করেছেন। সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সবাইকে এক কাতারে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলা তো মেনে নেওয়া যায়না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় কালের প্রয়োজনে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব আমরা চেয়েছি। তারাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই যে সংজ্ঞায়ন নিয়ে বারো দফা পার হলাম, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা নিজেরা নিজেদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সনাক্ত করছেন। কিন্তু এটি একটি করাপট্ সিস্টেম। একজন কমান্ডার কাউকে সার্টিফিকেট দিলেই সে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে। এবং নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। এর ফলে দুর্নীতির সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এবং প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ নয়।
যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজেই দুর্নীতিবাজ, নিজেই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সেখানে কেনো তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছেনা? এসবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা কী আইনে আছে ?
তুরিন আফরোজঃ অবশ্যই আইনে আছে। আমাদের প্যানাল কোডে বিভিন্ন ধারায় আছে, কেউ যদি নিজেকে ভুল পরিচয় বা অন্য পরিচয় দেয় সেটা দন্ডনীয় অপরাধ। এটা ৪১৬ ধারা। আমি যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিচ্ছি সেটি অপরাধ করছি। ৪১৯ এর অধীনে কমপক্ষে ৩ বছর জেল হওয়ার বিধান রয়েছে। ৪৭১, ৪৬৩-এর বিভিন্ন সেকশনে এই অপরাধের রায় পাবেন। কেউ যদি ভূয়া সার্টিফিকেট বা জাল দলিল তৈরী করে ( এটাও একটা জাল দলিল) সেখানে ২ বছর পর্যন্ত জেল হওয়ার বিধান আছে।
প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে যদি কোনো কাজ করা হয়, এটা তো প্রতারণাই- ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে আপনি ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নেবেন- তার মানে আপনি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি চুরি করছেন। রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করছেন। এর শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত জেল। ১৯৮ ধারায় মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে সুবিধা নিলে তিন থেকে সাত বছরের জেল হতে পারে।
প্যানাল কোডের অধীনে/আইনের অধীনে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যেমনঃ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তার অধিকার হরণ হচ্ছে বলে উচ্চ আদালতে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে রীট মামলা করতে পারেন।
অনুচ্ছেদ ৩১- এ আছে, আমার মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে আমার সুনাম ক্ষুন্ন না হওয়া। একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার কারণে সকল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সম্মান হানি হতে পারে।
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরীর ক্ষেত্রে অনেক সময় সিন্ডিকেট কাজ করে।
তুরিন আফরোজঃ অনেক সময় না, সব সময়। সিন্ডিকেট সব সময় কাজ করে। যে কমান্ডার কমান্ড করছেন বা ইস্যু করছেন, যে বা যারা প্রভাব বিস্তার করছে, যারা সহযোগিতা করছেন সকলকে বর্তমান আইনের আওতায় আনা সম্ভব।
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও প্রতারণা করছে, তাদের সন্তানরা সব ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে। তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?
তুরিন আফরোজঃ দেখুন, যে ফ্যামিলিতে শহীদ হয়েছে সে ফ্যামিলিগুলো উঠে আসতে পারেনি। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা চালাচ্ছে। যারা একসময় অস্ত্র হাতে অনিশ্চয়তার পথে (কারণ তারা তো জানতো না নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবে) যুদ্ধ করেছিলো তাদের অনেকে এখনো ভিক্ষা করেন। তাদের জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি।
সেখানে যদি একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সে সুযোগ নেয় তা কিন্তু মেনে নেওয়া যায়না। ভালো একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ বা ভালো নাগরিক হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা হওয়া আবশ্যক না। কিন্তু একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা কোনদিনও ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নাগরিক, রাজনীতিবিদ হওয়া সম্ভব না। তার সন্তানদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সে তো প্রতারক। তাকে বা তার সন্তানকে কেনো সুবিধা দেওয়া হবে? সে যেসব সুবিধা পাচ্ছে সেটা আমার আপনার টাকা। আমরা যে কর দিই সেই টাকা। সেই করের টাকায় কেনো ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা নিবে? তার সন্তানরা কেন সুবিধা পাবে?
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও যারা চাকরী করছে, প্রমাণ হলে চাকরী থেকে বহিষ্কার করা উচিত। যেসব সুবিধা তারা নিয়েছে তা ফেরত নেওয়া উচিত। তাদের উপর যে অর্থ জরিমানাসহ যে দন্ড আছে তা দেওয়া উচিত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে অনেকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাতা সহ নানা উপায়ে প্রচুর আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। সেক্ষেত্রে কী করা উচিত?
তুরিন আফরোজঃ সেসব অর্থ ফেরত নিতে হবে। রাষ্ট্রের স্বাভাবিক আইনে সেটা সম্ভব। আপনি অবৈধভাবে সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তা ফেরত দিতে হবেনা? সেটা তো আপনার না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে। ফৌজদারী আইনের ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হতে পারে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল হতে পারে।
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তিতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের ব্যাপারে আইন কী বলে?
তুরিন আফরোজঃ কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। সবাই সমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সমান সুযোগ সুবিধা পাবেন।” তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে যারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন তারা অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এই আইনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব।
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরণে কী কোন প্রস্তাব করবেন?
তুরিন আফরোজঃ যাচাই বাছাই প্রক্রিয়াটা যদি স্বচ্ছ রাখতে হয় সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে সে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। যা হবে প্রকাশ্যে। সাংবাদিকরা চাইলে বসে শুনবে। গোপনে হবে কেন? পেছনের দরজা দিয়ে কেন মুক্তিযোদ্ধা তৈরী হবে? সূত্র: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম ডেস্ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.